SPOTLIGHT: শিশুকামিতার নির্মম বাস্তবতার গল্প

যদি আপনি দরিদ্র ঘরের সন্তান হন, তাহলে আপনার জীবনে ঈশ্বরের মূল্য অনেক বেশি থাকে। এমন অনেক দরিদ্র পরিবারেই বাবা হয় মারা গেছে, নয়তো মা চলে গেছে সংসার ছেড়ে, অথবা এমনো হতে পারে যে বাবা-মায়ের সাথে আপনার সম্পর্ক ভালো না। এমন অবস্থায় যখন এলাকার চার্চ থেকে পাদ্রী বাসায় এসে দুটো মিষ্টি কথা বলে, তখন মনে হয় যেন স্বয়ং ঈশ্বরই নেমে এলেন পৃথিবীর বুকে, যেন কথা বললেন আপনার সাথে। বাচ্চাদের ওপর এটার প্রভাব পড়ে অনেক বেশি। তারা পাদ্রীদের ওপরে নির্ভর করতে শুরু করে। পাদ্রী সেই শিশুদেরকে নিজেদের সাথে রাখে, টুকটাক চকোলেট খেতে দেয়। মাঝে মাঝে পাদ্রীরা চার্চের ছোটোখাটো কাজের জন্য বাচ্চাদেরকে সাথে রাখে। যেমন, এটাসেটা এগিয়ে দেয়া, ময়লার ঝুড়িটা নিয়ে যাওয়া। কোমল মনগুলোর কাছে মনে হয়, যেন ওরা ঈশ্বরের কাজই করছে।

এরপর একদিন হয়তো পাদ্রী বাচ্চাটাকে একটা ডার্টি জোক বললো। এতে তেমন কোনো ক্ষতি হলো না, কিন্তু বাচ্চাটা বুঝতে পারলো যে এই ধরনের জোক আসলে সবার সামনে বলার জিনিস না। এখন শুধুমাত্র পাদ্রী আর বাচ্চাটার মধ্যে সীমাবদ্ধ একটা সিক্রেট তৈরি হলো। একটা সম্পর্ক তৈরি হলো, যেটার গণ্ডি শুধু ঐ দুইজনের মধ্যেই আবদ্ধ। পরে একসময় পাদ্রী কথার ছলে বাচ্চাটিকে পর্ন ম্যাগাজিনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সিক্রেট আরো গাঢ় হলো। এরপর বাচ্চাটিকে একদিন বললেন, “এটা তো তোমারো আছে, তাই না? কই দেখি তো!” অথবা “এমন জিনিস আমারো আছে, দেখবে?” বলে তাদের হাতে নিজের লিঙ্গ তুলে দেয়। বাচ্চাদেরকে লিঙ্গটা মুখে নিতে বাধ্য করে। এবং কখনো কখনো এই যৌন নির্যাতন এতোটুকুতে সীমাবদ্ধ থাকে না।

এমন একটা ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা কতটুকু? একটু সহজ করে দিচ্ছি, সম্ভাবনা শূন্য নয়। এটা ঘটেছে, ঘটছে। তাহলে একটু পরিবর্তিত প্রশ্ন – “এররকম ঘটনা কয়টি শহরে ঘটেছে বা শতকরা কতজন পাদ্রী ঘটিয়েছে? উত্তরটা চোখ ছানাবড়া করে দেয়ার মত। যারা আন্তর্জাতিক খবরের প্রতি ন্যূনতম আগ্রহ রাখেন, তারা জানেন এই বিষয়টা নিয়ে কী তোলপাড় হয়ে গিয়েছিলো এই শতাব্দীর শুরুর দিকেই। এখন সবাই জানে, ক্যাথলিক চার্চ আর শিশুকামিতার ভয়াবহতা! কিন্তু এই তোলপাড় শুরু করেছিলো কারা? কাদের মাধ্যমে গোটা দুনিয়া এটা নিয়ে কথা বলার মত যথেষ্ট উপাদান (তথ্য, সাহস) পেয়েছিলো? আবারো বলছি, বেশিদিন আগের কথা নয়, সমসাময়িক পৃথিবী নিয়ে আগ্রহ থাকলে জানবেন, এটা নিয়ে মিডিয়াতে জোরালোভাবে সরব হয়েছিলো একটা পত্রিকা। স্পষ্ট করে বলতে গেলে পত্রিকাটির একটা বিশেষ তদন্তকারী অংশ। পত্রিকাটির নাম The Boston Globe. আর তদন্তকারী অংশটির নাম SPOTLIGHT.

২০০১ সালের শুরুর দিকের কাহিনী! আগের সম্পাদক অবসরে চলে গেলে ফ্লোরিডা থেকে নতুন একটা সম্পাদক মার্টি ব্যারন এসে যোগ দিলো বোস্টন গ্লোবে। এবং এসে বোস্টন শহরের একটা মামলা নিয়ে হাল-হকিকত জানতে চাইলো – গেওগ্যান নামে এক যাজকের শিশুকামিতার ঘটনা। সেটার তদন্তের দায়িত্ব দিলেন স্পটলাইট টীমকে। তদন্ত করতে গিয়ে দেখা গেলো, গেওগ্যান একা নন। আরো ৪/৫টা এমন ঘটনা আছে শুধু বোস্টন শহরেই। স্পটলাইট টীম একটু ঘাবড়ে গেলো। এগুলো কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা? অনেক কাল আগে শিশুকামিতার শিকার হয়েছিলো, এমন একজনের সাথে কথা বলতে গিয়ে জানা গেলো, সে সারাজীবন এমন যাজকদের বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহে কাটিয়েছে। এবং শুধু বোস্টনেই এমন ১৩ জন যাজককে পেয়েছে। সংখ্যাটা বাড়ছে! যেহেতু কাহিনীটা বাস্তব এবং এহেন ঘটনা মোটামুটি সকলেরই জানা, তাই আমি আরেকটু বলতে চাইছি। দয়া করে Spoiler বলে চিৎকার করে উঠবেন না। মূল কাহিনীতে ঢোকার পরে কী হলো, তা আর বলবো না।

যাই হোক, টীম তদন্ত করতে গিয়ে দেখলো যে – যখনই কোনো যাজকের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আসে এবং মামলা করা হয়, তাদেরকে মামুলি একটা জরিমানা করা হয় এবং মানসিক অসুস্থতার জন্য ছুটি দেয়া হয়। তখন সেই অভিযুক্ত যাজকেরা মানসিক ডাক্তারের (থেরাপিস্টের) কাছে যায়। এমন একজন থেরাপিস্টের সাথে কথা বলে জানা গেলো, ৬% যাজকই এমন শিশুকামী হয়ে থাকেন। আতংকে সবার মাথায় যেন বাজ পড়লো! শুধু বোস্টনেই যাজকের সংখ্যা ১৫০০। ১৫০০ এর ৬% মানে হচ্ছে, ৯০ জন। শুধু কথাকে ভিত্তি হিসেবে না নিয়ে তারা আরো তদন্ত করতে ছুটলো। এবং হিসেব মিলিয়ে দেখা গেলো, ৮৭ জন যাজক এমন ঘটনার সাথে জড়িত। এবং এগুলো হচ্ছে শুধুমাত্র সেই ঘটনাগুলো যেগুলো মামলা পর্যন্ত এগিয়েছে। এদেরকে আদালতে প্রকাশ্যে নেয়া হয়নি, প্রাইভেট সেশনে বিচার করা হয়েছে। ভিকটিমকে সামান্য ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে, ক্ষমা চাওয়ার আনুষ্ঠানিকতা সারা হয়েছে, যাজকের পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। আদালত এদের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। কিন্তু সবচেয়ে শক্তিশালী বজ্রপাতটা হচ্ছে – ক্যাথলিক চার্চ তাদেরকে পুনরায় যাজকের পদে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছে। আরো ব্যাপক সত্যটা হলো – এটা ঘটছে গোটা দুনিয়া জুড়েই। ঠিকই পড়েছেন, গোটা দুনিয়া জুড়েই।

অর্থাৎ, লড়াইটা এখন শুধু বিচ্ছিন্ন কোনো অপরাধীর বিরুদ্ধে নয়, গোটা সিস্টেমের বিরুদ্ধে। কাহিনী এখানে এসে অনেক বড় হয়ে গেলো, যুদ্ধটাও। স্পটলাইট সাংবাদিকদের সামনে এখন একটা ধাঁধা – ওরা কি এই যাজকদের বিরুদ্ধে প্রকাশনা শুরু করে দেবে, যা আগেও বিচ্ছিন্নভাবে কিছু পত্রিকা করেছে? নাকি গোটা চার্চের বিরুদ্ধে আরো শক্তিশালী কেইস দাঁড় করাবে? সত্যিকারের পরিবর্তনের দায়িত্ববোধ থেকে তারা দ্বিতীয় পন্থাকেই বেছে নিলো।

সন্দেহ করার মত যথেষ্ট কারণ আছে যে, বাংলাদেশেও এমন পরিস্থিতি অতীতে তৈরি হয়েছে, বর্তমানেও সবার অগোচরে এই দুঃখজনক ঘটনাগুলো ঘটছে। বাসায় আরবী শেখাতে আসা হুজুরগুলোর একাংশ যে এভাবে নিষ্পাপ বাচ্চাগুলোর শৈশব নষ্ট করছে, তা মোটামুটি অনেকেই জানেন। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে এমন ৭ জনের কথা জানি, যারা আমাকে বিশ্বাস করে ওদের অভিজ্ঞতাগুলো বলেছে। আরো কতজন যে লোকলজ্জার ভয়ে কিচ্ছু বলতে পারেনি, কে জানে! বলবে কিভাবে? বাবা-মায়ের সাথে তো আমাদের সম্পর্ক মালিক-চাকরের মত। প্রায় যে কোনো ঘটনাতেই মা-বাবা’রা বাচ্চাদের বক্তব্যকে সম্পূর্ণ অবহেলা করে থাকেন, বাচ্চাদেরকেই দোষী সাব্যস্ত করে থাকেন। এই রকম যৌন নির্যাতনের কথা বলতে গেলে যদি তেমনই ঘটে – এই ভয়ে বাচ্চারা কিছু বলতে পারে না।

যাই হোক, সিনেমাতে ফিরে আসি। সিনেমার সবচেয়ে ভালো লাগা বৈশিষ্ট্য ছিলো এটার গতি এবং জটিল গল্পকে সহজে উপস্থাপন করার মত স্ক্রীনপ্লে। এমন জটিল কাহিনী নিয়ে শক্ত গাঁথুনির চিত্রনাট্য না থাকলে মহাভজঘট হয়ে যেতো। ক্যামেরার কাজের মধ্যেও সেই গতিটাকে ধরে রাখা হয়েছে। কোথাও কোথাও কালার থিমের পরিবর্তন করা হয়েছে, যেটা আসলে চোখে পড়ার কথা না; কিন্তু দৃশ্যটার দিকে আপনার মানসিকতার কম্পাসকে সঠিক দিকে রাখতে সহায়তা করবে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকও ছিলো একই রকম বেগময়। এক কথায়, পরিকল্পিত। পরিচালক Tom McCarthy কে স্যালুট! আর অভিনেতা বাছাইও মনে হয় এর চেয়ে ভালো আর হতে পারতো না।

সাংবাদিক মাইকেল রেজেন্দেস এর চরিত্রে ছিলো মার্ক রাফেলো। প্রথম থেকেই তাকে বেশ অস্থির দেখানো হচ্ছিলো। তার হাঁটাচলা, কথার ভঙ্গি, সবকিছুতেই একটা চঞ্চল ভাব ছিলো। এবং এটা কাহিনীর গতিতে অনেক সাহায্য করেছে পরের দিকে। তার অভিনয় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার মত ছিলো। স্পটলাইট টিমের প্রধান ওয়াল্টার রবিনসনের চরিত্রে মাইকেল কীটন অত্যন্ত আবেগী অভিনয় করেছে। সাংবাদিক সাশা ফাইফার-এর অনুসন্ধিৎসু চরিত্র যথাযথ রুপায়ন করেছে অভিনেত্রী র‍্যাচেল ম্যাকএডামস। আমার মতে, মেয়েটা ভুয়া চরিত্রে না গিয়ে এ ধরনের স্ক্রিপ্ট বাছাই করলে ক্ল্যাসিক হয়ে উঠবে। তেমন বেশি স্ক্রিন উপস্থিতি না থাকলেও দুটো চরিত্রের প্রতি বেশ আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। এক, সম্পাদক মার্টিন ব্যারন (অভিনয়ে Liev Schreiber); দুই, এক উকিল মিশেল গ্যারাবেডিয়ান (অভিনয়ে Stanley Tucci)। লীভ শ্রাইবারের গম্ভীর ফ্যাসফ্যাসে গলা অনন্য একটা গুরুত্ব এনে দিয়েছে মুভিটাতে। আর আরমেনিয়া থেকে আসা ব্যস্ত উকিলের চরিত্রে স্ট্যানলি টুচি’র সিরিয়াসনেস চোখে লেগে থাকার মত ছিলো। বলতে গেলে, পুরো সিনেমার কোথাও তাকে মাল্টিটাস্কিং ছাড়া দেখা যায়নি। সে লেখার ফাঁকে ডায়লগ দিচ্ছে, খাওয়ার মাঝে কথা বলছে – কাজের প্রতি আসলেই নিষ্ঠাবান লোকগুলো বুঝি এমনই হয়।

২০০২ থেকে শুরু করে স্পটলাইট টিম ছয় শতাধিক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। ২০০২ এর প্রথম ধাক্কাটা ছিলো টর্নেডোর মত। অনেক প্রতিক্রিয়া শুনতে হয়েছে তাদেরকে, কিন্তু আরো অনেক মানুষ এসে নিজেদের গল্প ভাগাভাগি করেছে টীমের সাথে। ২০০৩ সালে এটার সাথে জড়িত সাংবাদিকদেরকে পুলিৎজার পুরষ্কার দিয়ে সম্মান জানানো হয়। বোস্টন গ্লোবকে তার দুঃসাহসিক এই বিষয়টা নিয়ে কাজ করার জন্য বাহবা দেয়া হয়েছে।

মজার ব্যাপার শুনবেন? বোস্টনের বর্তমান কার্ডিনাল বলেছেন যে, এই সিনেমাটা নাকি কিভাবে সাংবাদিকরা ক্যাথলিক চার্চকে লজ্জাজনক এই অপরাধটাকে স্বীকার করতে এবং পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করেছে, তার সত্যিকারের চিত্র তুলে ধরেছে – এটাও বোস্টন গ্লোবেই ছাপা হয়েছে। জ্বি না, এই রিপোর্ট প্রকাশের পর বা সিনেমা বানানোর পরে ওরা স্পটলাইটকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়নি। বরং রিপোর্টের পরপর আমেরিকান ক্যাথলিক চার্চ প্রকাশ্যে অভিযোগ মাথা পেতে নিয়েছে। সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়েছে কিনা, বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু পদক্ষেপ কিছুটা হলেও নেয়া হয়েছে, সত্যিকারের পরিবর্তনের চেষ্টা করেছে সাংবাদিকেরা। বাংলাদেশে আরবী শেখানোর হুজুরদেরকে নিয়ে এমন একটা রিপোর্ট করলে বা সিনেমা বানালে কী হতো, সেটা নিয়ে চিন্তা করলেই আতংকে বুক কেঁপে যাচ্ছে। ঐ সাংবাদিকদেরকে আর খুঁজে পাওয়া যেতো না। সিনেমার পরিচালকের মাথা হয়তো চাপাতির কোপে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে থাকতো।

বিশ্বাস আমাদেরকে অন্ধ করে রাখে, বিশ্বাসকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে অনেক কিছু ধামাচাপা দেয়া যায়। তাছাড়া যারা বিশ্বাসকে নিজেদের জীবনের মূল ভিত্তি হিসেবে নেন, তারা নিজেদের অপরাধকেও ভুয়া ন্যায্যতা দিতে চান – এই ধরনের অত্যন্ত সংবেদনশীল সত্যকে নিয়ে কাজ করেছিলো সাংবাদিকেরা। তারাই আসলে সত্যিকারের নায়ক, তারাই পরিবর্তনের কাণ্ডারী। আর এই সিনেমাটা সেই সত্যকে তুলে ধরেছে, সত্যিকারের নায়কদের গল্প দেখিয়েছে। রটেনে ৯৬% ফ্রেশ সার্টিফিকেট এবং সেরা সিনেমা হিসেবে অস্কার পাওয়া এই সিনেমাটা দেখা প্রত্যেক সিনেমাপ্রেমীর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

Share:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *