ভারতীয় বাংলা সিনেমার মধ্যে একটা নতুনত্বের ছোঁয়া লেগেছে, এটা হয়তো অনেকেই লক্ষ্য করেছেন। কিন্তু কাল একটা বিশেষ জিনিস লক্ষ্য করলাম – ওরা ওদের কিংবদন্তীদেরকে সম্মান জানাতে আরম্ভ করেছে।
কয়েকদিন আগে ঋত্বিক ঘটককে নিয়ে একটা সিনেমা বানালো, মেঘে ঢাকা তারা। ঘটোকবাবুর জীবন, ওনার বানানো সিনেমাগুলো মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলো প্রধান চরিত্র নীলকণ্ঠ বাগচীর মধ্যে। ঘটকবাবুকে যে ওরা কেমন সম্মান করে, সেটা মুভির দৃশ্যগুলোর মধ্যে একদম স্পষ্ট। একদম সরাসরি কিছু উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু আপনার যদি ঘটকের কাজ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা থাকে, তাহলে বুঝতে একটুও সমস্যা হবেনা। নীলকণ্ঠ বাগচী যে সিনেমাগুলো বানাচ্ছিলো, সেগুলোর নাম দেখলেই বুঝতে পারবেন যে বলা হচ্ছে অযান্ত্রিকের কথা, বাড়ি থেকে পালিয়ে এর কথা, অথবা যুক্তি তক্কো গপ্পো এর কথা।
একটা সিনেমা দেখলাম, অপুর পাঁচালি। কাহিনীর শুরুটা অনেকটা এমন – বিভূতির গল্প থেকে বানানো সত্যজিত রায়ের “পথের পাঁচালি” সিনেমাতে অপু চরিত্রে যে শিশু শিল্পী অভিনয় করেছিলো, তার খবর জানেনা কেউ। সুবীর ব্যানার্জি নামের সেই চাইল্ড আর্টিস্ট এখন কোথায়? তার খোঁজ পড়লো। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র তাকে অনেক কষ্টে খুঁজে বের করলো। তার হাতে ধরিয়ে দিলো জার্মানী থেকে আসা একটা নিমন্ত্রণপত্র। কিন্তু সুবীর ব্যানার্জি যাবেন না কোথাও। একবার একটা আর্টিক্যালের মধ্যে অপুর জীবনের সাথে সুবীরের জীবনকাহিনীর অনেক মিল লিপিবদ্ধ করা হয়েছিলো। সিনেমাটার মধ্যে সুবীর-অপু যেন একীভূত হয়ে গেলো। সত্যজিত রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ফুটিয়ে তোলা হলো, তার অপু ট্রিলজির টুকরোগুলো এনে। অপু ট্রিলজি দেখা ছিলো অনেক আগেই, এভাবে করে আবার দেখে কেন যেন চোখে পানি চলে এলো।
আমাদের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের প্রতি একটি বিশেষ অনুরোধ – অত্যন্ত খুশি হবো, যদি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাতারা আমাদের কিংবদন্তীদের সম্মান জানিয়ে ট্রিবিউট নির্মাণ করেন। কিংবদন্তী যে কোনো ক্ষেত্রে হতে পারে। আমাদের জহির রায়হান আছেন, মুনীর চৌধুরী আছেন, শহীদুল্লাহ কায়সার আছেন, আছেন সুভাষ দত্ত, আছেন খান আতাউর রহমান, আছেন জয়নুল আবেদীন। আমাদের নতুন প্রজন্মের সাথে আরো বেশি করে পরিচয় করিয়ে দেয়া উচিৎ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাথে, শহীদুল জহিরের সাথে, আহমদ ছফার সাথে, শওকত ওসমানের সাথে।
বিশেষ করে একটা সিনেমা বানানোর জন্য প্লট একদম রেডি করাই আছে, বাস্তব ঘটনা দিয়ে সাজানো – শহীদুল্লাহ কায়সারকে ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর তুলে নিয়ে গেলো আল-বদর বাহিনী। দেশ স্বাধীন হবার পর তার ভাই জহির রায়হান তাকে খুঁজতে গেলেন মীরপুরে। মীরপুর তখন ঠিক ঢাকার ভেতরে না এখনকার মত, সেটা ছিলো বিহারী অধ্যুষিত এলাকা। সেখানে কে বা কারা (সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা – বিহারীরা বা ছদ্মবেশী পাকিস্তানি সৈন্যরা) তাকে গুলি করে হত্যা করে।
এমন একটা দমবন্ধ করা প্লট! আমাদের দুই কিংবদন্তীকে নিয়ে! আর কী লাগে? আমরা যখন আমাদের মেধাবীদেরকে, আমাদের কিংবদন্তীদেরকে সম্মান জানানো শুরু করবো, সেটার প্রভাব হবে বহুমুখী। সবচেয়ে বড় কথা, মেধার সম্মান জানানোর চর্চা তৈরি হবে। নতুন প্রজন্ম আমাদের অতীত কিংবদন্তীদের ব্যাপারে জানতে পারবে। তারা জাতি হিসেবে গর্ব করার কিছু উপাদান খুঁজে পাবে। তাদের মধ্যে কিছু একটা করে দেখানোর উৎসাহ আসবে।