একজন মাস্টারদা’র গল্প

নাম সূর্য সেন, ছিলেন স্কুল টিচার – তাই সবাই ডাকতো মাস্টারদা। সেখান থেকে হয়ে গেলেন ব্রিটিশদের আতংকের কারণ। ১৮৯৪ সালের ২২শে মার্চ জন্ম নেয়া এই হাল্কা পাতলা মানুষটার নেতৃত্বে আন্দোলনকারীরা চট্টগ্রামে ব্রিটিশদের অস্ত্রাগার লুট করে নিয়েছিলো।

চট্টগ্রামের রাউজান থানাতে তার জন্ম, নোয়াপাড়াতে। অনার্স পড়াশোনা করা অবস্থাতেই বিপ্লবী মানসিকতায় আকৃষ্ট হন। পড়াশোনা শেষ করে বাবার মতই শিক্ষকতায় যোগ দেন। প্রায় এক যুগের মত পড়িয়েছেনও, তাই কপালে মাস্টারদা’র উপাধি জুটেছিলো। কিন্তু তখন ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলন মাথাচাড়া দিচ্ছে সবখানে। তিনিও বিপ্লবে যোগ দিলেন।

১৯৩০ সালে সূর্য সেনের দল পরিকল্পনা করলো চট্টগ্রামকে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীন করা হবে। কীভাবে? চট্টগ্রামের সাথে বাকি ব্রিটিশ রাজ্যের সকল যোগাযোগ ব্যবস্থা নষ্ট করে দেয়া হবে। ট্রেন লাইন উপড়ে ফেলা হবে, টেলিফোন-টেলিগ্রাফ লাইন ধ্বংস করে ফেলা হবে, ব্রিটিশদের অস্ত্রাগার লুট করে তাদের অস্ত্রে তাদেরকেই ঘায়েল করতে হবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, অস্ত্র পেলেও গোলাবারুদ নিতে পারেননি তারা। আর ব্রিটিশরা কড়া প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর হয়ে গিয়েছিলো। পরবর্তীতে এই বিপ্লবীদের অনেকেই ব্রিটিশদের সাথে সংঘর্ষে মারা যায়, অনেকে গা ঢাকা দেয়।

সূর্য সেনও লুকিয়ে ছিলেন, কখনো এখানে, কখনো ওখানে। এমন একটা সময়েই প্রীতিলতার সাথে তার পরিচয় হয়েছিলো, তারিখ – ১৩ই জুন, ১৯৩২। ঐ সময়টাতে সূর্য সেন পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনা করছেন। ওই ক্লাবের প্রবেশপথে লেখা ছিলো, “কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ।” তিন মাস পর সেই আক্রমণে প্রীতিলতা নেতৃত্ব দেবেন, এবং ধরা পড়ার আগেই সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করবেন।

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার

সূর্য সেন তখনো গা ঢাকা দিয়ে। তার মাথার ওপরে বিশাল পুরস্কারের ঘোষণা আছে। তবু তিন বছরের মত তিনি লুকিয়ে ছিলেন। কিন্তু নেত্র সেনের বাড়িতে লুকিয়ে থাকার সময় তারই বিশ্বাসঘাতকতায় ব্রিটিশরা সূর্যসেনকে গ্রেফতার করে, ১৯৩৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। সূর্যসেনের মাথার ওপরে পুরস্কার ছিলো, সেই লোভেই হয়তো নেত্র সেন এই কাজ করেছিলো। সেই পুরস্কার ভোগ করতে পারেনি সে। পুরস্কার পাওয়ার আগেই এই বিপ্লবী এসে তাকে হত্যা করে। নেত্র সেনের স্ত্রীও বিপ্লবী মানসিকতার ছিলেন বলে হত্যাকারীর নাম কখনোই প্রকাশ করেননি।

কিন্তু গ্রেফতারেই সূর্য সেনের দুর্দশা শেষ হয়নি, বরং শুরু কেবল। তার ফাঁসির আদেশ হয়েছিলো। কিন্তু তার আগে ব্রিটিশরা তার সবগুলো দাঁত হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে ফেলে, তার নখগুলো প্লায়ার্স দিয়ে টেনে তুলে ফেলে। বলা হয় যে, তাকে ফাঁসিকাষ্ঠে নিয়ে যাওয়ার সময় তার জ্ঞান ছিলো না। তখন ১৯৩৪ এর জানুয়ারি।

ব্রিটিশদেরকে ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিলো তার ১৩ বছর পর। বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দেয়া সূর্য সেন বৃথা যায়নি। আজো আমরা তার নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান ডিপার্টমেন্টের (আমার আলমা ম্যাটার) ছাত্রাবাসের নাম করা হয়েছে তার নামে। কলকাতায় একটা মেট্রো স্টেশন আছে তার নামে। কলকাতা হাইকোর্টের সামনে তার একটা আপাদমস্তক মূর্তি আছে।

দুটো সিনেমা হয়েছে তাকে নিয়ে, “খেলে হাম জি জান সে” আর “চিটাগং” – দুটোই ভারতীয়দের বানানো। বাংলাদেশি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কাহিনীর এত অভাব! তারা কি এই কাহিনীগুলো চোখে দেখে না? সূর্য সেনের অস্ত্র লুট, বিশ্বাসঘাতকতা, গ্রেফতার, অত্যাচার; অথবা প্রীতিলতার পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব জ্বালিয়ে দেয়া, ধরা না দিয়ে সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করা – এগুলো নিয়ে কি দুর্দান্ত সব মুভি বানানো যায় না? মনোজ বাজপেয়ি নাকি চিটাগং সিনেমার জন্য কোনো পারিশ্রমিকও নেননি! বাংলাদেশের পরিচালক, অভিনেতারা কি এগুলো দেখে উদ্বুদ্ধ হন না?

শেষ করার আগে সূর্য সেনের শেষ চিঠিটা অনুবাদ করে শেষ করছি। শেষ চিঠিতে তিনি নিজের বন্ধুকে লিখেছিলেন – “মৃত্যু কড়া নাড়ছে আমার দুয়ারে। আমার মনটা অনন্তের উদ্দেশ্যে ভেসে যাচ্ছে।…… এই মনোরম কিন্তু থমথমে পরিবেশে, এই বিষণ্ন মুহূর্তে, কী রেখে যাবো আমি? হয়তো শুধু একটা জিনিসই রেখে যাবো – আমার স্বপ্ন, সোনালি একটা স্বপ্ন, স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন…… ১৮ই এপ্রিল, ১৯৩০ এর কথা কখনো ভুলে যেও না, চট্টগ্রামের পূবালী বিপ্লবের কথা ভুলে যেও না। যারা ভারতের স্বাধীনতার বেদীতে নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করেছে, তাদের নাম হৃদয়ের গভীরে লাল রঙে লিখে রেখো”।

Share:

3 comments

  1. মুক্তির মন্দির সোপান তলে
    কত প্রাণ হলো বলিদান
    লেখা আছে অশ্রুজলে…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *