বাংলাদেশ নিয়ে আইএস’এর পরিকল্পনা ও সমাধান

১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে দুটো রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হলো – ভারত আর পাকিস্তান। মাঝখানে ১২০০ কিলোমিটার লম্বদূরত্বের ভারত থাকা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তান মিলে এক পাকিস্তান করতে রাজি হলো তখনকার মুসলিমরা, কারণ সকল মুসলিম ভাই ভাই। ৩/৪ বছরের মধ্যেই সেই ভ্রাতৃত্বে ফাটল ধরলো, এবং ২৪ বছরের মধ্যে বোঝা হয়ে গেলো যে আসলে ধর্মের নাম করে রাষ্ট্রীয়ভাবে লুটতরাজ করে রাষ্ট্র চালানো এই উপমহাদেশে সম্ভব না।

এমন একটা যুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নেয়া রাষ্ট্র আগের সকল মতাদর্শ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নতুন একটা বিপ্লবী সংবিধান আঁকড়ে ধরবে – এমন হওয়াটাই সবচেয়ে বেশি স্বাভাবিক ছিলো। যেমনটা, ব্রিটেনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে উত্তর আমেরিকা করেছিলো। নিজস্ব পরিচিতি তৈরির জন্য আমেরিকা ভিন্ন অভিধান পর্যন্ত রচনা করেছিলো, যেটাকে আমরা এখন Merriam-Webster অভিধান নামে চিনি। ব্রিটেনের মূলভাব ছিলো একটি অভিজাত শ্রেণীর উচ্চাসন, তাই উত্তর আমেরিকা সংবিধানে লিখলো, “all men are created equal”. এবং পরবর্তীতে সকল দ্বন্দ্বের মধ্যেও ওরা এটাকে মেনে চলেছে। যেমন, দাসপ্রথা পরিহারের সময় বা নারী ভোটাধিকারের সময় এটা বুকে নিয়েই ওদের আদালত বা কংগ্রেস সিদ্ধান্ত দিয়েছে।

কিন্তু বাংলাদেশে সংবিধানের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়ার কথা থাকলেও আদতে তা গড়ে ওঠেনি। ১৯৪৭ এর ভূত রয়ে গিয়েছিলো বাংলার সর্ষের মধ্যে। এটাকে মেটানোর জন্য যেভাবে মানুষকে শিক্ষিত করে তোলা উচিৎ ছিলো, সেটা আমাদের দেশে হয়নি। যার যেটা মেনে চলার ইচ্ছা, সেই স্বাধীনতা থাকলেও আসলেই কোনটা মানা উচিৎ আর কোনটা মানা উচিৎ নয়, সেটা নিয়ে মানুষকে যথেষ্ট জ্ঞান দেয়া হয়নি। ফলাফল হিসেবে আজকে আমাদেরকে এই দিন দেখতে হচ্ছে।

“কী দিন আইলো রে!” বলে আশ্চর্য প্রকাশ করা আমাদের মানায় না। যারা ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন এবং সমাজের ভাব-ভঙ্গি বোঝেন, তারা এই দিনের কথা প্রায় ৩ দশক ধরেই বলছেন, আর অধিকাংশ মানুষ ৩ দশক ধরেই এটা অবহেলা করেছেন। ১৯৭৭ সালে যখন জিয়াউর রহমান জামায়াতের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা সরিয়ে নিলো, তখন কী মনে করেছিলেন আপনারা? কিছুই হবে না? ১৯৮৮ সালের অষ্টম সংশোধনীতে যখন ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা হয়, তখন কী মনে করেছিলেন আপনারা? বেশ উচিৎ একটা কাজ হয়েছে? একটুও কি ভেবেছিলেন যে, সব ধর্মের মানুষ এজন্য ৭১ সালে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলো? ২০০১ সালে যখন জামায়াতে ইসলামী যখন বিএনপির সাথে আঁতাত করে ক্ষমতায় চলে এলো, তখন কী মনে করেছিলেন? ভেবেছিলেন, আর যাই হোক, বাংলাদেশ পাকিস্তান হবে না? হুমায়ুন আজাদ থেকে শুরু করে যাদেরকে কোপানো হলো, তখন মনে মনে উল্লাস করেছিলেন, তাই না? ভেবেছিলেন, “ওরা তো আর আমরা না। ওদেরকে কোপানোই হয়তো ঠিক”। কিন্তু বোঝেননি যে, যারা কোপাচ্ছে, ওদের কাছে ওরা-আমরার সংজ্ঞা কতটা ঠুনকো! এখন ওরা আপনার দুয়ারে এসেও হাজির হয়েছে।

সন্ত্রাসীরা বেশ বড় একটা পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়েছে/এগোচ্ছে, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। প্ল্যানের প্রথম ধাপ হিসেবে প্রথম দিকে ওরা নাস্তিক কুপিয়ে নিজেদের নায্যতা হাজির করতে চেয়েছে, অধিকাংশ জনগণের মুসলিম অনুভূতির সাথে একাত্ম হতে চেয়েছে। এরপর দ্বিতীয় ধাপে ওরা একটা শো ডাউন করেছে এবং ভেতরে ভেতরে কিছু পরিবর্তন এনেছে, কিছু ক্ষমতা আদায় করে নিয়েছে। এখন চলছে তৃতীয় ধাপ – বিরতিহীন ত্রাস সৃষ্টির ধাপ। এই পর্যায়ে এসে অনেক সাধারণ জনগণ হতাশ হয়ে যাবে, মনে করবে এখন আর পিছু ফেরার কোনো পথ নেই। এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে ওরা সরকারের ওপর আরো জেঁকে বসবে, আরো ক্ষমতা আদায় করে নেবে।

শুনলে আশ্চর্য হবেন না, কিন্তু ভবিষ্যতে ওদের পরবর্তী লক্ষ্য হবে – বাংলাদেশের একাংশকে নিজেদের বলে দাবি করা; সেটা চট্টগ্রামের রাউজান-হাটহাজারী-টেকনাফ অঞ্চল হবার সম্ভাবনা বেশি। সেখানে ওরা পাহাড়ি অঞ্চলে আদিবাসীদেরকে নির্মূল করতে চেষ্টা করতে পারে। যেহেতু আদিবাসীদেরকে নিয়ে আপনার কোনো মাথাব্যথা নেই, তাই আপনার চোখের নিচ দিয়ে তারা ব্যাপক অস্ত্রের ভাণ্ডার তৈরি করতে থাকবে। আর টেকনাফ অঞ্চলে রোহিঙ্গাদেরকে সাথে নিয়ে মায়ানমার বর্ডারে একটা শোডাউন করতে পারে। এটা করলে তো অনেকের কাছে আইএস (ইসলামিক স্টেট) হিরো হয়ে যাবে। আপনি মনে করবেন, “আগে যা করেছে, ভুল করেছে; এখন যা করছে, ঠিকই করছে”। কোনোভাবে যদি মায়ানমার সরকার বাংলাদেশের এলাকাতে (আইএস এর ওপরেই) একবারও আক্রমণ করে বসে, তাহলে বাংলাদেশ সরকার আর আইএস তো “শত্রুর-শত্রু-আমার-বন্ধু” নিয়মানুসারে ভাই-ভাই হয়ে যাবে। এই একটা যুদ্ধ অনেক কিছু পাল্টে দেবে। এরপর ওরা আস্তে আস্তে গোটা বাংলাদেশ থেকেই গণহারে নিয়োগ করতে থাকবে এবং বাংলাদেশ হয়ে পড়বে একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। সেই ডামাডোলেই ওরা গণতন্ত্র সরিয়ে খিলাফত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবে।

এটা থেকে সমাধানের উপায় কী? উপায় হচ্ছে –

১) ওদেরকে এখনকার ছোটো ছোটো বিজয়গুলোর টার্গেট পূরণ করতে দেয়া যাবে না। সরকারের উচিৎ, all-out-action এ নেমে যাওয়া। এদের সাথে কূটনীতি করে কোনো সমাধানে পৌঁছানো যাবে না। এরা গভীরভাবে কুসংস্কারগ্রস্ত, অন্ধ। বখে যাওয়া ছেলের মায়ের মত “আয় সোনা, ফিরে আয়” বললেই এরা পাগড়ি ফেলে ফিরে আসবে না। এদেরকে ধরো, আইনের মাধ্যমে কঠিন শাস্তি দাও, এবং এদেরকে বোঝাও যে দেশে আইন আছে, চাইলেই যাচ্ছেতাই করা যাবে না। আর এরা প্রতিরোধ করলে, ধরতে এলে গুলি চালালে ক্ষমাহীন হও। যেমন কুকুর, তেমন মুগুর হতে হবে। এদের সকল লুকোনোর জায়গায় আক্রমণ চালাও।

২) মাদ্রাসা শিক্ষাকে নিষিদ্ধ করতে হবে। পাশাপাশি, সিলেবাস থেকে ধর্মশিক্ষা তুলে দিতে হবে। ধর্ম পড়ানো হবে অবশ্য, তবে ইতিহাসের স্টাইলে। যেমন, ২০০০ বছর আগে এরকম একজন এসে এরকম এরকম কিছু কথা বলেছেন; অসম্ভব হলেও কেউ কেউ মনে করে তিনি পানির ওপরে হাঁটতে পারতেন, পানিকে ওয়াইন বানাতে পারতেন। অথবা, ১৪০০ বছর আগে আরেকজন এসে এই এই কাজ করেছেন, এই এই দাবি করেছেন, ইত্যাদি।

৩) সরকারি দলের ভেতরেই কীট ঢুকে গেছে। এদেরকে খুঁজে বের করে আদালতে হাজির করে রাষ্ট্রদ্রোহের আওতায় বিচার করতে হবে।

৪) আইএস এর একটা অর্থনৈতিক খুঁটি আছে, সেটাকে একদম গোড়া থেকে ভেঙে দিতে হবে।

৫) রাষ্ট্রীয়ভাবে সেক্যুলার চিন্তার প্রসার করতে হবে। যে কোনো পাবলিক প্লেসে এখন শুধুমাত্র একটি ধর্মের চর্চা হয়, সেটা অন্য সকল ধর্মের জন্য অত্যন্ত অপমানজনক। বাসে, প্লেনে, ট্রেনে, লঞ্চে – সবখানে ইসলামী রীতিতে অভিবাদন জানানো হয়। যে দেশে সব ধর্মের মানুষ আছে, সেই দেশে কেন এটা স্বাভাবিক হয়ে গেলো? বিশ্ববিদ্যালয়ের মত প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানের শুরুতেও শুধু একটা ধর্মগ্রন্থ থেকে তিলাওয়াত করা হয়। কেন এটা সবার চোখে বেঁধে না? কেউ যদি ধর্ম মানতে চায়, নিজের মনে মনে মানবে। এরকম করে অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেবে কেন? এভাবেই আস্তে আস্তে একটা মতাদর্শিক আধিপত্য তৈরি হয়, যেটা কাটিয়ে ওঠা খুব মুশকিল হয়ে পড়ে।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, উপায়গুলোর প্রায় সবই সরকারি তরফ থেকে শুরু করতে হবে। তবে সরকার তখনই কোনো কাজ করে, যখন সেটার পক্ষে জনমত থাকে। বারাক ওবামা বা হিলারি কেউই পাবলিকলি সমকামী বিয়ের পক্ষে ছিলেন না, কিন্তু জনমত পাল্টানোর পর নিজেরাও সুর পাল্টেছেন। বাংলাদেশ সরকারও পাল্টাবে, যদি আপনারা চান।

নিজের দেশটাকে ইরাক, সিরিয়া, পাকিস্তানের মত অবস্থায় দেখতে না চাইলে আজই এই বিষয়ে খোলা চোখে তাকান। এই সন্ত্রাসীরা মুসলিম দেশেই কেন এত বেশি কর্মঠ? যে তিনটা দেশের নাম বললাম, এগুলো তো ইতোমধ্যেই মুসলিম দেশ! কিছু কি বোঝা গেলো? মুসলিম দেশগুলো থেকেই এদের যোদ্ধার যোগান হয় বেশি। এদেরকে কাজে লাগিয়ে এরা খিলাফত চায়, ক্ষমতা চায়, যার সাথে যেমন ইচ্ছা, তাই করতে চায়। যেহেতু ধর্মের নামে মানুষ পটানো সোজা, তাই এসব দেশেই এদের কাজ বেশি। আপনি যদি চান, ধর্মকে কাজে লাগিয়ে এদেরকে কিছু করতে দেবেন না, তাহলে ধর্মীয় মতাদর্শ থেকে আগে মানুষকে বের করে আনতে হবে।

বাংলাদেশে আইএস কতটুকু সফল হবে, সেটার দায়ভার আসলে আমাদের সবার। আইএস এর কোমর ভেঙে দেয়ার জন্য সরকারকে নিজ নিজ জায়গা থেকে চাপ দিন, বেশি বেশি লেখালেখি করে জনমত তৈরি করুন, নিজেরাও সেকুলারিটি চর্চা করুন। আসুন, বাংলাদেশকে এই সন্ত্রাসের মহামারী থেকে বাঁচাই। জয় বাংলা!

Share:

4 comments

    1. ধন্যবাদ। শুধু আশা করি, যে দিনের অনুমান করেছি, সেই দিন যেন না দেখতে হয়।

  1. আমার কথাগুলো কি সুন্দর করে বলে দিলেন আপনি ১ থেকে ৫ নম্বর আইটেম গুলো দিয়ে। আপনার মংগল কামনা করছি আর মগজহীন আম জনতার মাঝে ঘিলু ঢোকানোর প্রচেষ্টায় আমি আপনার সহযোদ্ধা।

    1. অনেক ধন্যবাদ আপনাকেও, সহযোদ্ধা হবার জন্য। নিজ নিজ জায়গা থেকে সেকুলারিটির চর্চা করতে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করা এখন সময়ের দাবি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *