মনের গভীরে আস্তানা গেড়ে নেয়া বিশ্বাস আর চোখের সামনে দেখা বাস্তবতা- এই দুইয়ের মধ্যে মাঝে মাঝে এক অন্তরীক্ষ দূরত্ব থাকে। এই দূরত্ব কীভাবে অতিক্রম করা যায়- সেটা নিয়ে যে কাউকে জিজ্ঞেস করবেন, সেই উপায়ও থাকে না অনেক সময়। বিশ্বাসের অনেক শক্তি! মানুষ বিশ্বাসের জন্য পাহাড় পাড়ি দিয়ে ফেলে, সাগর পাড়ি দিয়ে অন্য মহাদেশে চলে যেতে পারে, সকল কষ্ট সহ্য করে হাসিমুখে জীবন দিয়ে দিতে পারে; কিন্তু মাঝে মাঝে বাস্তবতার সাথে এক মঞ্চে এসে দাঁড়াতে পারে না। একজন বিশ্বাসী যখন সেই দ্বিধার মুখোমুখি হয়, তখন সে কী করতে পারে? মরুভূমির অমাবস্যা রাতের মত নিশ্চুপ হয়ে যাওয়া ছাড়া তার আর কী করার থাকে?
Silence – পরিচালক মার্টিন স্করসেসির আধ্যাত্মিক মুভি সিরিজের তিন নম্বর এবং শেষ সিনেমা। The Last Temptation of Christ বেরিয়ে ছিলো সেই ১৯৮৮ সালে, এরপর Kundun বেরুলো ১৯৯৭ সালে। সাইলেন্স নিয়েও স্করসেসি চিন্তাভাবনা করেছেন প্রায় ২৫ বছর ধরে। শুসাকু এন্দোর লেখা উপন্যাস থেকে বানানো এই সিনেমাটা যে কোনো পরিচালকের জন্যেই ঝুঁকিপূর্ণ প্রজেক্ট! এটার কাহিনী তো সাধারণ ভালো-মন্দ নিয়ে তো নয়; বরং দুটোর মধ্যে বর্ণনাতীত সংঘর্ষের। হায়, শুধু কী সংঘর্ষ? কোনটা যে ভালো, কোনটা যে মন্দ, সেটা বোঝাই তো বড় দায়!
সিনেমাতে যে দ্বন্দ্বটা দেখানো হয়েছে, সেই দ্বন্দ্বটা যেমন জটিল; এই সিনেমাটা নিয়ে রিভিউ লেখাটাও তেমনই জটিল। এটার পেছনে একটা ইতিহাস আছে, যেটা সিনেমাতে নেই, আমি Andrew Marr এর History of the World দেখতে গিয়ে এগুলো জেনেছিলাম। সিনেমা দেখার আগেই এই ইতিহাসটা জানা থাকা উচিৎ বলে আমি মনে করি। তাই শুরুতে আমি সেই ঐতিহাসিক পটভূমিটা বলার চেষ্টা করবো। যারা সিনেমাটা দেখে ফেলেছেন, তারা পটভূমিটা পড়ে দেখলে হয়তো বুঝতে পারবেন কাহিনীতে চরিত্রগুলো কেন কোন সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলো। যাই হোক, দ্বিতীয় অধ্যায়ে সিনেমার শুরুর দিকে সামান্য একটু আলোচনা করবো এবং অন্যান্য কিছু খুঁটিনাটি বলবো। তারপর তৃতীয় অধ্যায়ে স্পয়লার রিভিউ অংশে চলে যাবো। অর্থাৎ, তৃতীয় অধ্যায় পড়তে হলে সিনেমাটা দেখে আসতে হবে।
ঐতিহাসিক পটভূমি
আজ আমরা যে জাপানকে দেখি, সেই জাপান অন্যদের চেয়ে অনেক আলাদা মনে হয়। এমনকি তাদের পাশের দেশগুলোর মানুষদের চেয়েও জাপানী মানুষগুলো আলাদা। এই জাপানী ভাব কেন এত আলাদা, সেটার জবাব লুকিয়ে আছে ষোড়শ শতাব্দীর ইতিহাসে। তখন ইউরোপিয়ান খ্রিস্টানরা দুই দলে ভাগ হয়ে গিয়েছিলো, প্রটেস্টান্টরা ক্যাথলিক মতাদর্শ থেকে বেরিয়ে এসেছিলো মার্টিন লুথার কিং দের মত নেতাদের হাত ধরে (এই মার্টিন লুথার কিন্তু I have a dream বলা ব্যক্তি নন)। জার্মানিতে শুরু হওয়া এই আন্দোলনের মতাদর্শ ইংরেজ চার্চ গ্রহণ করেছিলো ভালোভাবেই। আর রোমান ক্যাথলিকরা সেটা মেনে নিতে পারেনি। তারা ১৬০৫ সালে গানপাউডার প্লটের মাধ্যমে প্রটেস্টান্ট রাজাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলো, গোটা পার্লামেন্টই উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলো, যা সফল হয়নি। এই ঘটনা হয়তো আপনারা অনেকেই জানেন।
রোমান ক্যাথলিকেরা অনেকদিন ধরেই ধর্ম প্রচার করছিলো, আর ওদের পর্তুগীজ জেসুইটরা জাপানেও পৌঁছে গিয়েছিলো ১৫৪৯ সালে। জেসুইট যাজকেরা দলে দলে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষা দিচ্ছিলো জাপানীদেরকে। সপ্তবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে, ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো প্রায় আড়াই থেকে তিন লাখে।
তখন সেখানে এলো ইংরেজ প্রটেস্টান্টরা। ক্যাথলিকেরা সেটা সহ্য করতে পারেনি। ঝড়ের আভাস শুরু হলো। কারণ, পর্তুগীজ জেসুইটরা জাপানের সাথে পর্তুগাল আর স্পেনের ব্যবসা বিস্তারে বড় ভূমিকা রেখেছিলো। আর এদের মূল উদ্দেশ্য ছিলো জাপানকে ক্যাথলিক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা। ১৬১৫ সালে প্রচুর জাপানী ক্যাথলিকের সমর্থন পেয়ে এক জাপানী সর্দার আরেক জাপানী সর্দারকে (ওসাকা প্রাসাদের সর্দারকে) আক্রমণ করে বসলো। ওসাকা প্রাসাদের সর্দারের আবার একটা প্রটেস্টান্ট পরামর্শদাতা ছিলো। এই আক্রমণের পর ওসাকা প্রাসাদের সর্দার অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হলেন। আন্দোলন তো দমন করলেনই, খ্রিস্টান ধর্মকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন, সকল পাদ্রীকে দেশছাড়া করলেন বা হত্যা করলেন। শুধু তাই নয়, জাপানীদের দেশের বাইরে যাওয়ার ওপরেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেন। জাপান নিজেকে গুটিয়ে নিলো। অন্যান্য দেশ যখন একে অপরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত, তখন ২৫০ বছর ধরে জাপান আর কোনো যুদ্ধে জড়ায়নি। অন্য ইউরোপবাসীদের জাপানে ঢোকা নিষিদ্ধ ছিলো বলে, ইউরোপের মহামারীগুলোও জাপানে ঢুকতে পারেনি। আর সংস্কৃতি! একদম আলাদা মানসিকতা আর সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিলো অন্য কারো সাথে না মেলামেশা করার ফলে, তাই আজকের জাপানীরা এত আলাদা! তাদের এনিমে, খাবার, কথা বলার স্টাইল, সবই বেশ আলাদা!
সেই নিষেধাজ্ঞার শুরুর দিকে, ১৬৩৩ সালে, সাইলেন্স সিনেমার কাহিনীর শুরু।
স্পয়লারবিহীন আলোচনা
ফাদার ফেরেইরা (লিয়াম নিসন) পর্তুগাল থেকে এসেছিলেন জাপানে। তার মত পাদ্রীদের হাতেই হাজার হাজার জাপানী বৌদ্ধ ধর্ম ছেড়ে ক্যাথলিক খ্রিস্টান হয়েছিলো। ফেরেইরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ধর্ম প্রচার করছিলেন, তিনিই ছিলেন সকলের উৎসাহের উৎস। কিন্তু সেই ফাদার ফেরেইরা নাকি খ্রিস্টান ধর্ম ছেড়ে দিয়েছেন; সবার সামনে ঈশ্বরের অবমাননা করে এখন জাপানীদের মত জীবনযাপন করছেন। এটা মেনে নিতে পারেনি দুই তরুণ পাদ্রী, রডরিগেজ (Andrew Garfield) এবং গারুপে (Adam Driver)–এরাও ফেরেইরাকে দেখেই পাদ্রীর জীবন বেছে নিয়েছিলো। তারা এটাকে গুজব মনে করলো এবং নিজেদের জীবন বিপন্ন করে জাপানে গিয়ে ফাদার ফেরেইরাকে খুঁজে বের করার প্রতীজ্ঞা করলো।
কাহিনীর প্রথম ১০ মিনিটে আমরা এতটুকু দেখলাম। এই জায়গাতে এসে অন্তত এটুকু বুঝেছিলাম যে এটা কোনো উদ্ধার অভিযান টাইপ ফিল্ম নয়। সিনেমাটা খুবই সিরিয়াস ধাঁচের, কিন্তু এই পর্যায়ে এসে একটু মজা করার লোভ সামলাতে পারছি না। লিয়াম নিসনকে নিয়ে একটা মিম (meme) আছে; যেখানে দেখা হয় যে সে নার্নিয়াতে আজলান ছিলো, ক্ল্যাশ অফ টাইটানসে যিউস ছিলো, স্টার ওয়ার্সে জেডাই মাস্টার ছিলো, ব্যাটম্যান বিগিন্সে ব্যাটম্যানের ট্রেইনার ছিলো, তারপরেও তোর কত বড় সাহস যে তুই ওর মেয়েকে কিডন্যাপ করিস? Taken সিনেমার কথা হচ্ছিলো, বুঝেই তো ফেলেছেন। সেই লিয়াম নিসনকে যে উদ্ধার করার দরকার হবে না এই সিনেমাতে, সে আর বলতে?
তবে একটা সিরিয়াস জিনিসও বুঝতে পেরেছিলাম। এই সিনেমাতে কোনো বিজয়ী দল থাকবে না। ধর্ম এমন সংবেদনশীল একটা বিষয়, এখানে সবাই যার যার নিজের মত করেই নিজের কৃতকর্মকে ব্যাখ্যা করতে চাইবে। এখানে মনের গভীরে আঁকড়ে বসে থাকা বিশ্বাসের ওপর যেমন জোর দেয়া হবে, তেমনি রুক্ষ ও প্রতিকূল বাস্তবতার ওপরেও আলোকপাত করা হবে। শুরুর ১৭/১৮ মিনিটের দিকে একটা দৃশ্যে এমন দেখা যায় যেখানে রডরিগেজ আর গারুপে জাপানে পৌঁছে একটা লুকিয়ে থাকা খ্রিস্টান গ্রামের সন্ধান পায়। সেখানে সবাইকে রাতের খাবার দেয়ার পর দুই পাদ্রী প্রার্থনা না করেই খাওয়া শুরু করে দেয়, কিন্তু জাপানী খ্রিস্টানরা খাবার মুখে দেয়ার আগে প্রার্থনা শুরু করে। এটা বোধহয় বাস্তবতার সাথে প্রথম এবং সবচেয়ে সহজ সংঘর্ষ! এটা যে আরো তীব্র হবে, কোনো সন্দেহ নেই।
মুভিটা অত্যন্ত শান্ত, কোনো তাড়াহুড়ো নেই, কোনো অতিরিক্ত উত্তেজনা নেই। শুধু অভিনয় ছিলো। বিশেষ করে এন্ড্রু গারফিল্ডের সেরা দুটো অভিনয়ের মধ্যে এটা একটা মনে হয়েছে আমার কাছে (অন্যটা Never Let Me Go). খুব সম্ভবত শুধু একটা দৃশ্যে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছিলো, অন্যান্য দৃশ্যে তাও ছিলো না। মুভির নাম নীরবতা, আর নীরবতা এখানে উল্লেখযোগ্য একটা ভূমিকা পালন করেছে। নীরবতার অনেক রুপ, অনেক কারণ! শান্তি যেমন নীরবতা নিয়ে আসতে পারে, হতাশা আর অসহায়ত্বও পারে, যন্ত্রণাও পারে। শান্তির নীরবতাগুলো আসলেই নীরব, অসহায়ত্বের নীরবতার ভেতরে একটা ঝড় থাকে।
সিনেমাটা বক্স অফিসে ফ্লপ, ভালোভাবেই ফ্লপ। রটেন টোমেটোর সমালোচকদের ৮৫% এর কাছে ফ্রেশ মনে হলেও সাধারণ দর্শকদের কাছে হয়তো আড়াই ঘণ্টা বেশি লম্বা মনে হয়েছে, বেশি ধীর মনে হয়েছে। কিন্তু প্রতিটা মুহূর্তে যে টানাপোড়েনে ভুগছে চরিত্রগুলো, নিজেকে নিজে যে প্রতিমুহূর্তে কাটাছেঁড়া করছে – সেটা বিবেচনায় আনুন, তখন দেখবেন সিনেমাটার গতি আসলে জীবনের মতই। অনেকটা ডকুমেন্টারি স্টাইল চিত্রনাট্য, ব্যাকগ্রাউন্ড ন্যারেশন – এগুলো সেটারই প্রতিনিধিত্ব করবে। আর বক্স অফিসের চিন্তা করে স্করসেসি এই সিনেমাগুলো বানান না। এই ট্রিলজির আগের দুটো মুভির একটাও বক্স অফিসে চলেনি। তবু তিনি এটা বানিয়েছেন, এটা তাকে বানাতে হতো।
সিনেমাটার পরিচালক নতুন হলে তাকে যে কী পরিমাণ তোপের মুখে পড়তে হতো, কে জানে! স্করসেসি বলে হয়তো পার পেয়ে গেছেন। তার ওপর ওনার বুকের পাটা আছে বলতে হয়, কারণ সিনেমাটা তিনি মুক্তি দিয়েছিলেন ক্যাথলিক চার্চের প্রাণকেন্দ্র রোম শহরে, যেখানে ভ্যাটিকান সিটি অবস্থিত। বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মকে কেন্দ্র করে এমন একটা সিনেমা বানানো হলে হয়তো দাঙ্গা বেজে যেত।
একটা সত্যি কথা বলি, সিনেমাটা দেখতে দেখতে আমার কাছেও মনে হচ্ছিলো যে এটাকে হয়তো আরেকটু ছোটো করা যেত, অথবা এমন আরো কিছু টুকিটাকি। কিন্তু সিনেমাটা শেষ করার পর থেকে যতবারই এটার কথা মনে পড়ছে, ততবারই বুকটা কেমন যেন জ্বলেপুড়ে উঠছে, চোখটা ভিজে উঠছে। এমন একটা অনুভূতির জন্য লেখক, পরিচালক, অভিনেতাসহ সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। এন্ড্রু গারফিল্ড আর মার্টিন স্করসেসি’র নাম আলাদা করে উল্লেখযোগ্য।
লিয়াম নিসন এই সিনেমার ব্যাপারে একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “মার্টিন স্করসেসির সাথে কাজ করার অফার ফিরিয়ে দেবার সাহস কার আছে? উনি খুবই সম্মানিত একজন পরিচালক এবং অভিনেতাদের ব্যাপারেও তিনি একদম আলাদা। তার মত মনযোগ এবং মূল বিষয়ে ঢুকে যাওয়ার ক্ষমতা, অভিনেতাদের জন্য সেটের মধ্যে তিনি যা তৈরি করে রাখেন, এক কথায় অনন্য। অবশ্য এই উত্তেজনার সাথে নিজের কাছ থেকে কিছুটা প্রত্যাশাও থাকে। মার্টিনকে সবাই ভয় পায়। উনি একজন কিংবদন্তী – আর একজন অভিনেতা হিসেবে এই জিনিসটা মেনে নিয়ে সেটা কাটিয়ে উঠতে হবে। আমাকেও কাটিয়ে উঠতে হয়েছে। তিনি সেটের মধ্যে নিশ্ছিদ্র নীরবতা চেয়েছেন; এমন নীরবতা যে যখন তিনি নির্দেশনা দিচ্ছেন বা কোনো দৃশ্য বুঝিয়ে দিচ্ছেন, তখন অন্য কেউ অন্য কোনো কাজ করতে পারবে না। কেউই না, মানে ৪০০ গজ দূরে যে লোকটা আঁকাআঁকি করছে, ওকেও থেমে যেতে হবে। একটা ছোটো শব্দ শুনলেও ব্যাপারটা তার জন্য ভেস্তে যায়, এবং তিনি এই সম্মানটুকু আদায় করে নেন। তিনি সেই নীরবতার কড়া আদেশ দিয়েছেন, এবং এই সিনেমার জন্য এটা বেশ জরুরি ছিলো।”
সিনেমাতে একটা দৃশ্য ছিলো, যখন ফাদার রডরিগেজের ধার্মিক মন সত্যিকার বাস্তবতার মুখোমুখি হয়; যখন তাকে ভালো-মন্দের সংজ্ঞা নতুন করে বেছে নিতে হয়, নিজের মনের গভীরে প্রোথিত বিশ্বাস কী বয়ে নিয়ে এসেছে, সেটা যাচাই করে দেখতে হয়। এই দৃশ্যটা দেখতে দেখতে আমি নিজেই আধ্যাত্মিকতার চূড়ায় পৌঁছে গিয়েছিলাম, রডরিগেজের হাহাকার বয়ে চলে এসেছিলো আমার নিজের মনেও। আমি নিজে ধার্মিক না হওয়া সত্ত্বেও রডরিগেজের ধার্মিকতা আমাকে ছুঁয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত রডরিগেজ কী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটা পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করছি; তবে সেটা ছিলো বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থেই।
স্পয়লারযুক্ত আলোচনা
রডরিগেজের সাথে শেষ পর্যন্ত ফাদার ফেরেইরার দেখা হয়, এটুকু তো বুঝেই ফেলেছেন। সেই দৃশ্যে ফেরেইরাকে জাপানী বেশে দেখা যায়; তিনি একটা লাইব্রেরির মত জায়গায় গবেষণা করছেন, তার জাপানী স্ত্রী-সন্তান আছে। এবং গুজবটাও সত্যি, তিনি আসলেই খ্রিস্টান ধর্ম ছেড়ে দিয়েছেন। তবু যখন রডরিগেজের সামনে এসে বসলেন, তার চেহারায় দ্বিধা আর ক্ষমাপ্রার্থনার ছাপ ছিলো। নতুন একটা ধর্মের দুটো রুপ (ক্যাথলিক আর প্রটেস্টান্ট) এসে অনেক ধর্মান্তরিত জাপানীদের শান্তি কেড়ে নিয়েছিলো, এটা দেখে তিনি নিজের ধর্মচর্চা বিসর্জন দিয়েছিলেন। ঠিক একইভাবে ফাদার রডরিগেজও বিসর্জন দিয়েছিলেন। কিন্তু দুজনের কেউই আসলে মন থেকে ধর্ম বিসর্জন দিতে পারেননি। মনে মনে ক্যাথলিক থাকলেও বুঝতে পেরেছিলেন, ধর্ম আসলে কোনো সমাধান না।
ফাদার ফেরেইরা একটা দৃশ্যে বলছিলেন যে খ্রিস্টান ধর্ম জাপানে শেকড় গাড়তে পারবে না। বলছিলেন, সত্যিকার অর্থে যে খ্রিস্টান ধর্ম ওরা প্রচার করতে এসেছে, সেটার নিজস্ব একটা সংস্করণ জাপানীরা মনে মনে গড়ে নিয়েছে। দৃশ্যটা দেখার সময় একদম নতুন কিছু অনুভূতি মাথাচাড়া দিয়ে যায়। যখন ফাদার ফেরেইরা বলেন যে, “ওরা খ্রিস্টান ধর্মের ঈশ্বরের ধারণা বুঝতেই পারবে না, কারণ ওরা প্রকৃতির বাইরে চিন্তা করতে পারে না; মানুষের চেয়ে ওপরে কিছু আছে, এটাই তারা বোঝে না।” আসলেই তো! ইসলাম ধর্মেও কি আমরা ঠিক তাই করিনি? আরবের ইসলাম যখন এই উপমহাদেশে এসেছিলো, তখন সে নিজেকে যথেষ্ট পরিমাণ পাল্টেই এসেছিলো, অনেকটা কোমল হয়ে নিজেকে উপস্থাপিত করেছিলো। নয়তো কখনোই এখানকার মানুষ ইসলাম গ্রহণ করতো না। তবে এই বিশ্বায়নের যুগে আমরা যখন আরবে গড়ে ওঠা ইসলামের কঠোর রুপ দেখছি, তখন সেটাকে কোনোভাবেই সচেতন মন দিয়ে মেনে নিতে পারছি না। আমাদের মধ্যে অনেকেই বলছে, “ওটা সহীহ ইসলাম নয়”। খুব অল্প (অত্যন্ত অল্প) সংখ্যক লোক যারা আরবের ইসলামকে এখন মনেপ্রাণে ধারণ করছেন, তাদের জন্যেই সংকট প্রকট রুপ ধারণ করেছে। জাপানে ঐ সময় যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিলো, সেই দ্বন্দ্ব এখন বাংলাদেশেও দেখা দিয়েছে।
আর এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমাদেরকেও এই দুই ফাদারের মতই বেছে নিতে হবে – ধর্ম নাকি বাস্তবতা? এই দুই ফাদারই মনে ধর্ম নিয়েই মৃত্যুবরণ করেছেন, শুধু আশেপাশের বাস্তবতাটাকে শান্তিময় রাখার জন্য নিজেরাই খ্রিস্টান ধর্মের কিছু জাপানে ঢুকতে দেননি। নিজেরা নীরব হয়ে গেছেন, কারণ ওরা দেখেছিলেন, প্রার্থনা করে মানুষের শান্তি ফিরিয়ে আনা যায়নি। তাদের ঈশ্বরও তো আসলে নীরবই ছিলেন। তাই ওরা নীরব ঈশ্বরকে একপাশে রেখেই, মনের গভীরে রেখেই, নিজের জীবনটাকে সঁপে দিয়েছিলেন মানুষের জন্য।