সংশয়বাদিতা, ধোঁকাবাজির টীকা

ইমেইল আবিষ্কার হবার পরপর এক দল ধোঁকাবাজ বের হয়েছিলো, যারা নিজেকে নাইজেরিয়ান বা অন্যান্য আফ্রিকান প্রিন্স দাবি করতো। ওদের নাকি অনেক (মিলিয়ন-বিলিয়ন) ডলার টাকা ট্রান্সফার করা দরকার। ওরা আপনার মাধ্যমে ট্রান্সফার করবে, বিনিময়ে আপনাকে ১ মিলিয়ন ডলার দিয়ে দেবে। কিন্তু প্রথমে নাকি আপনাকে ১০০০ ডলারের মত (বা এমন কোনো একটা পরিমাণ) ওদেরকে দিতে হবে। ইমেইলগুলোর ভাষা এতোটাই সাদামাটা যে খুব সহজেই এদের ধোঁকাবাজি ধরে ফেলতে পারি আমরা অনেকেই। কিন্তু এজন্যেই মনে হয় ভাষাটা বেশি সরল রেখেছে ওরা। কারণ এত সরলের পরেও যারা বুঝবে না, নিঃসন্দেহে ওদেরকেই ওরা টার্গেট করেছে। ইদানিং এটা কমে এসেছে, তবে মোটেও বন্ধ হয়ে যায়নি।

পাশাপাশি, প্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে মানুষকে ধোঁকা দেয়ার নতুন নতুন সিস্টেম বের হয়েছে। আমার আম্মুর মোবাইলে এমন একটা মেসেজ এসেছিলো যে, উনি লটারি জিতেছেন এবং ১০০০ টাকার মত পাঠিয়ে রেজিস্ট্রেশন করলেই উনি পুরষ্কার ১০ লাখ টাকা পেয়ে যাবেন। উনি আরেকটু হলে ধোঁকা খেয়েই গিয়েছিলেন। ফ্লেক্সিলোডের দোকানদারের কাছে গিয়ে এটার সত্যতা যাচাই করতে গিয়ে তবে রক্ষা হলো!

কিছুদিন ধরে একটা গ্রামার টেস্ট দেখছি, যেটা চ্যালেঞ্জ করছে যে “দেখি, আপনার গ্রামারের দৌড় কেমন?” একজন ফুল স্কোর পেয়ে ফেসবুকে শেয়ার দেয়াতে আমিও যাচাই করতে গেলাম। দেখি, আমি সেরা, আমিও তার মায়েরে বাপ লেভেলের গ্রামারবিদ, একদম ২৫-এ ২৫। সন্দেহ হলো! আরেকবার ঘেঁটে দেখতে গেলাম। দ্বিতীয়বারেই জারিজুরি বুঝে ফেললাম। ইচ্ছে করে ভুল দাগালেও ওরা ২৫/২৫ দিয়ে দিচ্ছে। এবং কারণটাও পরিষ্কার! আপনি ফুল মার্কস পাওয়া বাচ্চার মত “মা, মা, আমি ১০০ তে ১০০ পেয়েছি” টাইপের কিছু একটা লিখে ফেসবুকে শেয়ার দেবেন। এর চেয়ে কম পেলে হয়তো দিতেন না, অনেক কম পেলে জীবনেও দিতেন না। যাই হোক, এই শেয়ারে আরো অনেক অনেক মানুষ এই লিংক পেয়ে যাবে, এবং ওদের ওয়েবসাইটে মানুষের আনাগোণা বাড়বে। যত বেশি আনাগোণা, তত বেশি বিজ্ঞাপন পাবে ওদের ওয়েবসাইট, তত বেশি টাকা গুণবে ওয়েবসাইটের মালিক।

এটা নিয়ে বেশি উচ্চবাচ্য করতাম না। তবে একটু ভাবতেই ধোঁকাবাজির অতীত-বর্তমান আর এই নির্দিষ্ট গ্রামার ধোঁকাবাজির অনেকগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত সম্ভাব্য ভবিষ্যতের কথা মাথায় এলো। এক, যারা ভুল উত্তর দিয়েও সঠিক হবার বাহবা পেয়েছে, তাদের মাথায় এই ভুলগুলো রয়ে যাবে। পরে অন্য কোথাও সেই ভুলগুলোই পুনরাবৃত্তি করবে, এবং কোথাও না কোথাও ধরা খাবে। বিশেষ করে এখন অনেক অপ্রাপ্তবয়স্করাও ফেসবুক ব্যবহার করছে, ওরাও ভুল তথ্যগুলো নিয়েই দিনশেষে ঘুমাতে যাবে।

আরেকটা জিনিস যেটা আমাকে পীড়া দিচ্ছে, সেটা হলো – মানুষ এত খারাপ ক্যামনে হয়? মানুষকে ধোঁকা দিতে এতটুকু বাধে না? মালিকরা শ্রমিকদেরকে ধোঁকা দিচ্ছে, সরকার জনগণকে ধোঁকা দিচ্ছে, ভাই ভাইকে ধোঁকা দিয়ে সম্পত্তি আত্মসাৎ করছে, ফুটপাতের মলম বিক্রেতারা পথচলতি গরীবদেরকে ধোঁকা দিচ্ছে, কোম্পানির প্রচারের জন্য ৩০০ টাকার লাইট ১০০ টাকায় বিক্রি করা লোকগুলো মধ্যবিত্তদেরকে ধোঁকা দিচ্ছে, ধনীরা গরীবদেরকেও ধোঁকা দিচ্ছে, একে অপরকেও ধোঁকা দিচ্ছে — সীমাহীন ধোঁকাবাজি চলছে সবখানে, প্রতিদিন। আর বেশির ভাগ ধোঁকার মূলেই হচ্ছে টাকা। আর সেটা এখন বাচ্চাদেরকে ধোঁকা দেয়ার লেভেলেও নেমে এসেছে।

সব দেখে শুনে যা বুঝলাম – আমাদের এই প্রজাতির মধ্যে ধোঁকা দেয়ার মানসিকতা যেমন আছে, তেমনি ধোঁকা খাওয়ার জন্যেও আমরা উন্মুখ হয়ে থাকি। ঠিক যে মানসিক অবস্থার বশবর্তী হয়ে আমরা জাদু দেখতে যাই এবং মুগ্ধ হই, ঠিক সেই মানসিকতাই আমাদেরকে ধোঁকা খাওয়ার জন্য উদগ্রীব করে রাখে সবসময়। এবং যে যেভাবে পারবে, এটার সদ্ব্যবহার করবে। এটা নতুন কোনো গল্প নয়। আগে যে মানুষ খুব ভালো ছিলো, তা না কিন্তু। বা ধোঁকা খাওয়ার জন্য আমাদের যে বাসনা, সেটাও নতুন কিছু না। এজন্য আমরা একই জিনিসে বারবার ধোঁকা খাই।

আপনারা অনেকেই হয়তো পি টি বারনুমের কথা জানেন। সে একই মানুষকে কতবার যে ধোঁকা দিয়েছে, তাও আবার একই জিনিস দিয়ে। বারবারই সে মানুষকে বলেছে, “সত্যিকারের মারমেইড দেখতে চলে আসুন”। মানুষ গিয়েছে, ধোঁকা খেয়েছে। আবারো সে লিফলেট বিলি করে প্রচার করেছে, “এবারেরটা কিন্তু আসল”। মানুষ আবারো ধোঁকা খেয়েছে। আর এর আগেও সমগ্র জাতি বিভিন্ন নতুন মতবাদে ধোঁকা তো খেয়েছেই। কিছু ধোঁকার মাশুল আমাদেরকে শত শত বছর গুণতে হয়েছে; আর কিছু কিছু এখনো গুণে চলেছি।

ধোঁকার একমাত্র টীকা হলো – সংশয়বাদিতা; নতুন কোনো ধারণা সামনে আসামাত্র সেটাকে সত্যি বলে না মনে করা, যাচাই করার মানসিকতা রাখা, এবং যাচাই করার সময় “আমি ধোঁকা খাচ্ছি না” এই প্রশ্নটা অন্তত একবার হলেও নিজেকে করা। একটা জিনিস লক্ষ্য করে দেখুন, এই সকল ধোঁকার পেছনে একটা মূল সূত্র আছে – they make you feel good; ওরা আপনাকে বেশ সুন্দর একটা অনুভূতি দেয়। আপনার মধ্যে একটা সুখানূভুতি চলে আসে, এবং তখনই আপনার চারপাশে সংশয়বাদিতার যে নিরাপত্তা বলয় থাকে, সেটা গায়েব হয়ে যায়। তখন আপনাকে ধোঁকা দেয়া সহজ হয়ে যায়। আমরা অস্বস্তিকর ধারণাগুলো দিয়ে সাধারণত ধোঁকা খাই না, স্বস্তিকর ধারণাগুলো দিয়েই খাই। তো, এরপর যদি কখনো কোনো ধারণা আপনাকে একটু বেশিই সুখানুভূতি দেয়, একটু বেশিই স্বস্তির বেড়াজালে আটকে ফেলে, তখনই নিজের সন্দেহবাদী মনটাকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তুলুন। একদম শতভাগ স্বস্তিদায়ক ধারণাই যে ধোঁকা দেবে, এমনটা নয়। তবে সকল স্বস্তিদায়ক ধারণাই ধোঁকা দিতে সক্ষম। তাই, নিরাপদে থাকা ভালো।

সংশয়বাদ_জিন্দাবাদ!

Share:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *