সে এক আদ্যিকালের কথা। আরবের লোকেরা তখন খোরমা খেজুর খেয়ে জীবনধারণ করতো। ইন্টারনেট থেকে মুভি ডাউনলোড করে মুভি দেখার সময় তখনো আসেনি। ডিভিডি ভাড়া করে এনে দেখা অথবা স্টার মুভিজ, এইচবিও-ই তখন ভরসা। জি-স্টুডিওতে ঢুঁ মারা হতোনা সচরাচর। তবে যখন খবর পেলাম, পাইরেটস অফ দ্যা ক্যারিবিয়ান দেখানো হবে, তখন সিদ্ধান্ত নিলাম, আজকে রাতের জন্য না হয় জি-স্টুডিও’ই সই !!
The curse of the black pearl (2003)
বিজ্ঞাপন থেকেই জানতে পেরেছিলাম, সিনেমাটা নাকি ফ্যান্টাসী। কিন্তু কিসের কী ! ৩০-৪০ মিনিট পার হতে চললো, অবাস্তব কিস্যু তো দেখায় না, শুধু একটা হার্ট-বিটের শব্দ হলো একটু জোরে সোরে, আর এদিকে ওদিকে দু একটা ঘটনায় কিঞ্চিৎ সন্দেহের বাত্তি জ্বলে। এ আর এমন কী ! ৫৬ মিনিটের সময় গিয়ে ধাক্কাটা দেয় ব্ল্যাক পার্ল। এটা জানা থাকার পরেও প্রথম ছাপ্পান মিনিট আপনাদের অস্বস্তি থাকবে, উত্তেজনায় সমস্যা হবেনা, তাই বলতে দ্বিধা করলাম না…
সাগরের বুকে উন্মত্ত এক জলদস্যুর জাহাজ ভেসে বেড়ায় বলে গুজব আছে, নাম – ব্ল্যাক পার্ল; নামের মত কালো পতাকা উড়িয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজ লুট করে বলে শোনা যায়। চোখে সেই জাহাজ দেখেছে, এমন দাবি করা মানুষের সংখ্যা খুবই কম। আজ রাতে সেই জাহাজ আর জাহাজের ভয়ংকর ক্যাপ্টেন বারবোসা সংক্রান্ত পুরাণগুলো ভয়াবহ সত্য বলে প্রমাণিত হবে। আজ রাতে সে আসছে ব্রিটিশ নোঙ্গর পোর্ট রয়েল-এ। পোর্ট রয়েলের একজন বাসিন্দার কাছে এমন কিছু একটা আছে, যা সেই পাইরেটসদের প্রয়োজন, Bootstrap Bill ওরফে বিল টার্নারের স্বর্ণমুদ্রা !!
অনেক বছর আগে ব্ল্যাক পার্ল সাগরের বুকে লুকিয়ে থাকা এক দ্বীপে (Isle da Muerta, উচ্চারণ- ই’ল ডা মার্টা, স্প্যানিশ উচ্চারণ – ই’লা দ্যা মুয়ের্তা) অন্যান্য গুপ্তধনের সাথে খুঁজে পেয়েছিলো সোনার মোহরভর্তি বিশেষ এক বাক্স। ইচ্ছেমত খরচ করে ফেলেছিলো, মোহরগুলো ছড়িয়ে পড়েছিলো বিভিন্ন জায়গায়। কিন্তু তারা আবিষ্কার করলো, ভয়ানক এক অভিশাপ জড়িয়ে আছে এই মোহরগুলোর সাথে। ততক্ষণে যা দেরি হবার, হয়ে গেছে। উপায় আছে একটা, কিন্তু সেজন্য সবগুলো মোহর আবার জড়ো করতে হবে। আজ রাতে আসছে ব্ল্যাক পার্ল, শেষ মোহরটা সংগ্রহ করতে। অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে আরেকটা জিনিস লাগবে, সেটা এখন বলে দিয়ে (যারা এখনো দেখেনি, সেই হতভাগাদের) মজা নষ্ট করতে চাইনা।
Well defined character set (Jack Sparrow চরিত্রে, SORRY……. CAPTAIN JACK SPARROW চরিত্রে Johnny Depp এর গুণগান একটু পরে করছি। Captain না বললে সে আবার একটু মাইন্ড খায়) দুর্দান্ত ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, শক্ত ভিতের কাহিনী, গতিমান এবং একটু ডার্ক চিত্রনাট্য, প্রত্যেকটা চরিত্রের ক্লাইম্যাক্স – সব মিলিয়ে ডিজনী এর কমপ্লিট ফান প্যাকেজ এবং আমার দৃষ্টিতে সবচেয়ে well-made film of the trilogy – The Curse Of the Black Pearl.
Dead Man’s Chest (2006)
Fifteen men on a dead man’s chest
Yo ho ho and a bottle of rum.
Drink and the devil had done for the rest
Yo ho ho and a bottle of rum.
২০০৬ সালে এই মুভিটা মুক্তি পাওয়ার পর আমাদের ভার্সিটির ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এটা দেখানোর সিদ্ধান্ত নিলো। দল বেঁধে সবাই রওনা দিলাম দেখতে। সমস্যা হচ্ছে, আমি ছাড়া গ্রুপের বাকি কারো curse of the black pearl দেখা নাই। অগত্যা আমাকেই রাস্তায় যেতে যেতে পুরো সিনেমার কাহিনী বলতে হলো। ওরা দেখে নিলেই পারতো, কারণ কাহিনী বলতে আমার এক ঘণ্টার ওপরে লেগেছিলো। আমি যে একটু বেশি কথা বলি (অথবা ডিটেইলস-এ বলতে পছন্দ করি) এটা তো নিশ্চয়ই টের পেয়ে গেছেন……
যাই হোক, Bootstrap Bill এর কাহিনীটা অনেকটা এরকম। বিল টার্নার গুপ্তধন আবিষ্কারের রাতে ব্ল্যাক পার্লে ছিলো, ক্যাপ্টেন বারবোসার সাথে তর্ক করার কারণে তাকে ফেলে দেয়া হলো সাগরে। যাতে সাঁতার কাটতে না পারে, সেজন্য তার দুই পায়ের জুতার ফিতা (bootstrap) দিয়ে তাকে বেঁধে দেয়া হয়েছিলো। তখন থেকে তার নাম Bootstrap Bill. মোহরের অভিশাপে আক্রান্ত বিল টার্নার শেষ পর্যন্ত গিয়ে পড়ে আরেক অভিশপ্ত জাহাজ, THE FLYING DUTCHMAN-এ, যার ক্যাপ্টেন এর নাম শুনলে যে কোন জলদস্যুর আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যায়, Captain Davy Jones. আর সামুদ্রিক যুদ্ধে Dutchman যে কি করতে পারে, সেটা না হয় মুভিতেই দেখে নিলেন !!
প্রথম পর্ব দেখা আছে, অথচ এই মুভি দেখতে বসে জ্যাক স্প্যারো’র আগমনী সিনে হাততালি দেয়নি, এমন দর্শক হলে ছিলোনা। তার চেহারা দেখা যায়নি তখনো, কিন্তু পাবলিক ঠিকই বুঝে ফেলেছে এই জিনিস আমাদের ডিয়ার ওল্ড জ্যাক। শুরুতেই দেখা যায়, সে একটি বাক্সের সন্ধানে আছে। নিজের জীবন বাজি রেখে সেই বাক্সের চাবির হদিস বের করার চেষ্টা করে সে। কিন্তু সফল হয়না। এই বাক্সটাই প্রথম পার্টের সেই গুপ্তধনের বাক্স কিনা সেটা দেখার জন্য এবং সেই বাক্স নিয়া কি করা হবে সেটা জানার জন্য দেখতে বসে যান Dead Man’s Chest. সবাই খুঁজছে এই বাক্স, এমনকি বিল টার্নারের ছেলে উইলিয়াম টার্নারও…
কোন এক বিশেষ কারণে ট্রিলজির ফার্স্ট পার্টকে সবচেয়ে well-made মনে হলেও বারবার দেখার মত উপাদান আছে Dead Man’s Chest-এ। আমি দাবি করতে পারবো, যারা এ মুভিটা একবার দেখেছে এমন দর্শকের চেয়ে দু-দু’বার করে (হাইফেন আছে, খুব খিয়াল কইর্যা কিন্তু) দেখেছে, এমন দর্শকের সংখ্যা বেশি। হলিউডের ভিলেন জগতে আমার তৃতীয় ফেভারিট ভিলেন এই সিনেমার Davy Jones. প্রথম ফেভারিট Joker (by Heath Ledger, from The Dark Knight), দ্বিতীয় ফেভারিট যুগ্মভাবে Smith (by Hugo Weaving, from The Matrix) and Anton Chigurh (by Xavier Bardem, from No Country For Old Men).
Davy Jones চরিত্রে আছেন আমার আরেক পছন্দের অভিনেতা Bill Nighy. এই সিনেমাতে তার কথা বলার স্টাইল আমি নকল করেছি যখন তখন, মজা করার জন্য। প্রথমটা পাঁচটা অস্কার নমিনেশন পেয়েছিলো, পায়নি যদিও একটাও। এটা একটা নমিনেশন কম পেলেও একটা অস্কার ঠিকই বাগিয়ে নিয়েছে, for visual effect.
At World’s End (2007)
The king and his men, stole the queen from her bed, and bound her in her bones.
The seas be ours, and by the powers, where we will, we’ll roam.
Yo ho, all hands, hoist the colors high;
Heave ho, thieves and beggars, never shall we die.
শেষ পর্যন্ত গানটা গেয়েছে জলদস্যুদের দল, এটার জন্যে অপেক্ষা করছিলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লর্ড কাটলার বেকেট। এই দিনের জন্য অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করেছে সে, এই দিনের জন্য নিজেকে অনেকদিন ধরে প্রস্তুত করেছে সে। ওদিকে আরো হিংস্র হয়ে উঠেছে Davy Jones, Flying Dutchman এর কামান গর্জন করছে গোটা আটলান্টিকে। পুরনো হিসেব-নিকেশ সব খোলাসা হবে পৃথিবীর শেষ প্রান্ত, At World’s End এ গিয়ে।
বেশি কিছু বলতে পারছিনা। যাই বলবো, প্রথম দুই (স্পেশালি, সেকেন্ড) পার্টের জন্য স্পয়লার হয়ে যাবে। আমার মতে, এই সিনেমাটারও ভিজ্যুয়াল ইফেক্টে অস্কার পাওয়া উচিত ছিলো। ঐ বছর The Golden Compass কেন পেয়েছে, সেটা আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে ঢোকেনা, বিজ্ঞরাই ভালো বলতে পারবেন।
এটার পরেও আরো একটা পাইরেটস মুভি বের হয়েছে, কিন্তু সেটাকে আমি ট্রিলজির বাইরেই রেখে দিয়েছি। On Stranger Tides এর ডিরেক্টর Gore Verbinski নয়। আর তাছাড়া সেটার কাহিনীও অনেক দুর্বল, অরিজিনাল ট্রিলজির ধারে কাছেও না।
Over The Trilogy, Over Again
একই সিনেমাতে কমেডি আর ট্র্যাজেডি এতো সুন্দর করে coincide করানো যায়, Gore Verbinski এর পাইরেটস ট্রিলজি সেটার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। চলচ্চিত্র জগতের সবচেয়ে প্রিয় তিনটা চরিত্রের নাম বলতে গেলে পাইরেটস অফ দ্যা ক্যারিবিয়ানের JACK SPARROW (আমাদের Johnny Depp ভাইয়া)-এর নাম আসবে না, এমন মুভিখোর বোধহয় কমই আছে।
অসামান্য শক্তিশালী কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী (Jeoffrey Rush, Orlando Bloom, Keira Knightley) থাকার পরেও জ্যাক স্প্যারো যতক্ষণ সে স্ক্রীনে থাকে, ততক্ষণ অন্য কারো দিকে চোখ পড়ে না। এই মুভিতে জনি ডেপ যা করে দেখিয়েছে, জ্যাক স্প্যারো চরিত্রে অন্য কাউকে কল্পনা করতে গেলেও দর্শকের হজমে সমস্যা শুরু হয়। Johnny Depp কেন যে অস্কার পেলো না, সেটার যৌক্তিক বা আধ্যাত্মিক কোন ব্যাখ্যা নাই।
মানুষের চরিত্রের অদ্ভূত খেয়ালগুলো এতো সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই মুভিগুলোতে, এতো সূক্ষভাবে বিশ্বাস আর বিশ্বাসঘাতকতার স্বরুপ দেখানো হয়েছে, লক্ষ্য করার মত। লক্ষ্য অর্জনে মরিয়া হয়ে ওঠা, অথবা কিছু করতে না পারার অসহায়ত্ব, যুগপৎ এই সিনেমার কাহিনীকে চালিয়ে নিয়ে গেছে। বিনোদন চাইলে বিনোদন, লেসন চাইলে লেসন – উদ্দেশ্য যেটাই হোক না কেন, সফল করতে সক্ষম Pirates Of The Caribbean, an ultimate fun ride.
বিঃদ্রঃ অনুবাদকদের আড্ডার আয়োজনে তিনটি মুভির সাবটাইটেলই বাংলা অনুবাদ করেছিলাম আমরা। সেগুলো দেখতে হলে ক্লিক করুন এই লিংকে – পর্ব ১, পর্ব ২, পর্ব ৩।