ভূমিকা
পালমিরা, গৌরবোজ্জ্বল অতীত ইতিহাস সমৃদ্ধ প্রাচীন এই শহরটি বর্তমানে সিরিয়ার ভূ-খণ্ডে পড়েছে। প্রত্নতত্ত্ববিদেরা এখানে মাটি খুঁড়ে যা দেখেছেন, তাতে বোঝা গেছে যে এখন থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগেও এই শহরে মানুষের বসতি ছিলো। বলা যায়, আরব অঞ্চলের সভ্যতার উৎপত্তি হয়েছিলো এই জায়গাতে। ২০০০ বছর আগে এটা রোমান সাম্রাজ্যের দখলে আসে এবং এর সমৃদ্ধি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। তখনই এখানে তৈরি হয় চমৎকার সব স্থাপত্য। ২০১৫ সালে ধর্মভিত্তিক সন্ত্রাসী সংগঠন আইসিস এই শহরটা দখলে নেবার পর এইসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ভেঙে ফেলে, গুঁড়িয়ে দেয় হাজার বছরের পুরনো সভ্যতার চিহ্নগুলো। সবকিছু নিয়ে আমরা আরেকটু বিস্তারিত জানবো। শুরু করছি, পালমিরা’র জমকালো ঐতিহ্য আর ইতিহাস দিয়ে।
পালমিরা, হাজার বছরের পুরনো সভ্যতা
তৃতীয় খ্রিস্ট শতাব্দীর মাঝামাঝি এবং শেষের দিকে (২৬০ খ্রিস্টাব্দের দিকে) পালমিরা তার সভ্যতার উৎকর্ষে পৌঁছে। ততদিনে পালমিরাতে তৈরি করা হয়েছিলো Great Colonnade আর Temple of Bel এর মত বিখ্যাত সব স্থাপত্যগুলো। এগুলো ইতিহাসের সাক্ষী। আর তাই ইউনেস্কো এগুলোকে World heritage Site বলে ঘোষণা করেছিলো। অনেকেই হয়তো এই জায়গাগুলোর ছবি দেখেছেন। নিচে দেখতে পাচ্ছেন Temple of Bel এর ছবি।
রাণী জেনোবিয়ার সময় এই শহরের নিদর্শনগুলোর ওপর একবার হামলা চলে। আপনারা অনেকে হয়তো আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরিতে রোমান সম্রাট অওরেলিয়ানের (Aurelian) হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞের কথা জানেন। সেই হামলার সূত্রপাত এই পালমিরার রাণী জেনোবিয়ার বিদ্রোহ দমন করতে গিয়েই হয়েছিলো। ২৭৩ খ্রিস্টাব্দের দিকে সম্রাট অওরেলিয়ান আলেকজান্দ্রিয়াতেও হামলা করেছিলেন, অনেক নিদর্শন ভেঙে দিয়েছিলেন। তিনি এখানেও হামলা করে নিদর্শনগুলোর ওপর এক হাত নিয়েছিলেন। শহরের লোকেরা আগে প্যাগান (বহু ঈশ্বরে বিশ্বাসী ও মূর্তিপূজক) ছিলো, পরে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হলো। পরে আরেক রোমান সম্রাট ডায়োক্লেটিয়ান কিছু কিছু নিদর্শন পুনঃনির্মাণ করেছিলেন, কিন্তু একবার ধ্বংস করে ফেললে পুরোটা কি আর পারা যায়?
এরপর বিশ্ব সম্মুখীন হলো আরেক ধর্মের, ইসলাম। পালমিরা’র লোকেদের ভাষা হয়ে গেলো আরবী। যাই হোক, ততদিনে পালমিরা তার গৌরব হারিয়েছে। ধ্বংসযজ্ঞের পর পালমিরা উৎকর্ষের কেন্দ্র থেকে সরে গেছে। অনেক বছর এভাবে চলার পর সুন্নি মুসলিম সম্রাট তৈমুরের বংশধরেরা, ১৪০০ সালের দিকে আরেক দফা ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এবারের ধ্বংসকার্য শহরটাকে মামুলি একটা গ্রামে রুপান্তরিত করে।
বিংশ শতাব্দীতে এসে পালমিরা’র অতীত গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে আক্ষরিক অর্থেই মাটি খুঁড়ে বের করে নিয়ে আসেন প্রত্নতত্ত্ববিদের দল। তারা অত্যন্ত যত্নে বেশ কিছু নিদর্শন বের করে নিয়ে আসেন। ১৯৮০ সালে ইউনেস্কো এই এলাকাটাকে সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে World Heritage Site হিসেবে ঘোষণা করে। এখানে প্রচুর পর্যটক সমাগম হতো। কিন্তু সিরিয়ার ক্রান্তিলগ্নে অনেক কিছুই পাল্টে গেলো। ১৯৯৯ এর দিকে ISIS আত্মপ্রকাশ করলো, তখন অবশ্য ওদের নাম ISIS ছিলো না। ২০১৪ এর দিকে নামটা ISIS (Islamic State of Iraq and Syria) বা IS (Islamic State) বা ISIL (Islamic State of Iraq and the Levant) হয়েছিলো। নিদর্শনগুলোর কফিনে সর্বশেষ পেরেকটা এরাই ঠুকলো।
আইসিসের ধ্বংসযজ্ঞ
২০১৪ সালে আইসিস সারা বিশ্বে খেলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। ২০১৫ এর মে মাসে এই সন্ত্রাসী সংগঠনটি পালমিরা দখল করে। এরপর বিভিন্ন সময়ে ওরা বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ ছাড়ে যেখানে দেখা যায় ওরা হাজার হাজার বছর পুরনো নিদর্শনগুলো ধ্বংস করছে। মিউজিয়ামটাকে ওরা ব্যবহার করেছে আদালত আর কারাগার হিসেবে, প্রাচীন রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটারটাকে (ওখানে নাটক, যাত্রা হতো, সেটাকে) ব্যবহার করেছে জনসম্মুখে হত্যা করার জন্য। ব্যাপারটা অনেকটা এমন। আজ যেখানে শাহবাগ জাদুঘর, সেটার সদর দরজাকে ব্যবহার করা হচ্ছে সর্বসম্মুখে আমাদেরকেই হত্যা করার জন্য। এই নিদর্শনগুলোর কেয়ারটেকার খালিদ আল আসাদকে এরা ঐ মিউজিয়ামের দরজার সামনেই শিরচ্ছেদ করে হত্যা করেছে।
ধ্বংস করার প্রথম খবর পাওয়া গেছে স্যাটেলাইট ছবি থেকে। পরে আইসিস নিজেরাই ভিডিও ছেড়েছে। কিছু ভিডিও আছে বোমা দিয়ে পুরো এলাকা ধ্বংসের ভিডিও, কিছু ভিডিওতে [১] দেখা যাচ্ছে ওরা বিভিন্ন যন্ত্রপাতি (ড্রিল, হাতুড়ি) দিয়ে ভাঙছে স্থাপত্যগুলো।
ভাঙার আগে ও পরে
ভাঙার আগে ও পরে ছবিগুলো দেখলে বুক ভেঙে যায়। আর ভাঙার দৃশ্যগুলো দেখলে তো কথাই নেই। জাতিসংঘ এটাকে আইসিসের যুদ্ধাপরাধের তালিকাতে এই স্থাপত্যগুলো নষ্ট করার অপরাধও যুক্ত করেছে।
মার্গারেট ব্রেনন (আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিনিধি) বলেছেন [২], আইসিস যে শুধু অতীত ধ্বংস করছে তাই নয়। এরা আসলে পালমিরা বা সিরিয়াবাসীর ভবিষ্যতও ধ্বংস করছে। কারণ, এই জায়গাগুলোতে প্রচুর পর্যটকের সমাগম হতো। এখানে অনেক মানুষ ঘুরতে আসতো, ওদের অর্থনীতিকে চাঙা করতো। এখন যুদ্ধ শেষ হলেও এই জায়গাগুলোতে মানুষ কম আসবে। কারণ, এখানে তো এখন দেখার মত কিছু নেই। পালমিরাতে তো বটেই, আরো অনেক জায়গাতেই আইসিস এই ভয়াবহ কার্যক্রম চালিয়েছে, এবং মানবজাতির অপূরণীয় ক্ষতি করেছে [৩]।
তার ওপর আরেকটা ঘটনা ঘটছে যেটাতে আইসিসের হিপোক্রেসি খুব নগ্নভাবে উঠে আসছে। ওরা বলছে, এগুলোকে ওরা ধ্বংস করতে চায় কারণ এগুলো নাকি ইসলাম পূর্ববর্তী নিদর্শন। একটা ভিডিওতে একজন সন্ত্রাসী বলছিলো, “আমরা বহুদেবতার সকল চিহ্ন বিনাশ করে দেবো। এবং এভাবেই একদিন আমেরিকার মাটিতে হোয়াইট হাউসকেও চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেবো।” অথচ, ছোটো ছোটো অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এরা কালোবাজারে বিক্রি করে অর্থ যোগাড় করছে। সেই নিদর্শনগুলো দিয়েই নিজেদের জিহাদের খরচ চালাবে বলে।
পালমিরা’র পুনর্দখল
আইসিসের কাছ থেকে স্থানীয় জনগণেরা এমনই অত্যাচারের মুখোমুখি হচ্ছিলো যে রাশিয়ান বিমান আক্রমণকেও স্বাগত জানাচ্ছে ওরা [৪]। কী আর করবে? ওদের ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে আইসিসের জন্য, পরিবার আর বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে আলাদা হতে হয়েছে ওদের জন্য। ওদের মতে, আইসিস যে শুধু ভবন ধ্বংস করছে, তা নয়; আসলে ওরা আমাদের সংস্কৃতিটাকেই ধ্বংস করে দিচ্ছে। তাই, আইসিসের হাত থেকে পুনর্দখলের প্রয়াসকে ওরা স্বাগত জানিয়েছে।
২০১৬ সালের মার্চের ৮ তারিখ সিরিয়ার সেনাবাহিনী, জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী, আর রাশিয়ার বিমান বাহিনী একত্রে আক্রমণ শুরু করে। প্রথমে আশেপাশের পাহাড়ী এলাকাতে আক্রমণ চালিয়ে অবশেষে ওরা আইসিসের ঘাঁটিতে পৌঁছেছে। মার্চের ২৭ তারিখ খবর এলো [৫], পালমিরাকে পুনর্দখল করা হয়েছে। এই আক্রমণে কতজন আইসিস সন্ত্রাসী প্রাণ হারিয়েছে, তা এখনো জানা যায়নি।
উপসংহার
ইতিহাস নাকি নিজেকে পুনরাবৃত্ত করে। তবে ইতিহাস চর্চা করে আমাদের যে শিক্ষাটা নেয়া উচিৎ সেটা হচ্ছে – খারাপ ঘটনাগুলোর যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়, আমরা যেন সেই উদ্দেশ্যে কাজ করি। আজ থেকে প্রায় ১৭০০ বছর আগে আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরিকেও এভাবে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিলো। এককালের সমৃদ্ধ লাইব্রেরির কিছুই বলতে গেলে অবশিষ্ট নেই। আমরা সেই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হয়েছি। আমরা আইসিসকে এই ধরনের ভয়াল কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখতে পারিনি। ফলাফল হিসেবে, পালমিরার ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক কিছু নিদর্শন আমাদের হাত ফসকে বেরিয়ে গেছে। পরবর্তী প্রজন্ম শুধু এগুলোর গল্প শুনবে, নিজ চোখে গিয়ে ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছু দেখবে না।
তবে এভাবে চলতে দেয়া যায় না। যেভাবে সম্ভব, সেভাবে এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে। আসল কারণ সনাক্ত করতে হবে। ধর্মীয় মতাদর্শিক আধিপত্য আমাদের বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়ছে। ধর্মরক্ষার নামে খুনোখুনি হচ্ছে, ধর্ষণ হলেও ধর্মের দোহাই দিয়ে ধর্ষিতাকেই দোষী সাব্যস্ত করা হচ্ছে (বলা হচ্ছে যে, আচার-আচরণ বা পোশাক নাকি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে শালীন ছিলো না), বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হচ্ছে ধর্মের ওপর আঘাত আনার দোহাই দিয়ে।
আমাদের (মানুষদের) মধ্যে অস্বীকার করার একটা জোর প্রবণতা আছে। নিজের ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের আদর্শগত সমস্যা দেখলে সেগুলোকে এড়িয়ে যাওয়ার বা অস্বীকার করার প্রবণতা। তাদেরকে অনুরোধ করছি, ঘটনাক্রম পর্যবেক্ষণ করুন। বাংলাদেশ খুব শীঘ্রই সিরিয়া বা ইরাকে পরিণত হবে, যদি এখনই সচেতন না হন।
তথ্যসূত্র
[১] ভিডিও – https://www.youtube.com/watch?v=JmrPxy-K7W4
[২] ভিডিও – https://www.youtube.com/watch?v=73-2iXkrAyM
[৩] ভিডিও – https://www.youtube.com/watch?v=mvOofC7zxjY
[৪] ভিডিও – https://www.youtube.com/watch?v=KkFKQKVe7No
[৫] http://www.almasdarnews.com/article/breaking-syrian-armed-forces-liberate-palmyra-2/