প্রথম পর্ব – মৌসুমী ভৌমিকের সাথে কাটানো কৈশোর
এবার আপনাদের সামনে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করবেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র উপমহাদেশের বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী পণ্ডিত সৌরভ বড়ুয়া – আমার বন্ধু সৌরভকে গান গাইতে বলতাম এভাবে। আমি আর সৌরভ স্বঘোষিত বিখ্যাত শিল্পী ছিলাম। একজন আরেকজনকে গান গাইতে বলার আগে কিছুটা ভূমিকা করতাম। আমি গাওয়ার আগে সেও উপস্থাপকের সুরে বলতো, “বিশেষ অনুরোধের আসরে আজ আমাদের মাঝে আছেন আধুনিক ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অন্যতম পুরোধা, উপমহাদেশের বিখ্যাত সুরসাধক ওস্তাদ ফরহাদ হোসেন মাসুম” – ওস্তাদ বলার সময় কানের লতি ছুঁয়ে নিতো 😛
সৌরভের সিগনেচার টিউন
মনে করেন, সৌরভের গান আপনি আগে কখনো শোনেননি। তাকে প্রথমবারের মত অনুরোধ করলেন একটা গান গাইতে। আমি মোটামুটি নিশ্চিত সে রবীন্দ্রনাথের “এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম” গানটাই গাইবে। আরো একটা মজার ব্যাপার, সে গানটা শুরু করবে মাঝখান থেকে, এরপর শুরুর জায়গাটা গাইবে। তাকে একদিন প্রস্তাব দিলাম, সে গান গাইবে, আমি রেকর্ড করবো। আন্দাজ করেন তো, সে কোন গানটা গেয়েছে? হা হা হা, দেখতে পারেন সেই ভিডিওটা এইখানে, এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম – রবীন্দ্রসংগীত by সৌরভ বড়ুয়া. গানটা অনেক শিল্পীই গেয়েছে, তবে সৌরভের ব্যক্তিগত পছন্দ হচ্ছে সাগর সেনের ভার্সনটা. গাওয়ার সময় বোঝাই যায় যে সে সাগর সেনকে মাথায় রেখে গানটা গাইছে। আর গানটা সে যেমন দরদ দিয়ে ভেতর থেকে গায়, অন্তত আমার কাছে অনেক ভালো লাগে।
দ্যা রয়েল হাট প্র্যাংক
সেলিব্রেট করার মত কিছু হলেই কাজীর দেউড়ির রয়েল হাটে চলে যেতাম চিকেন চাপ আর পরোটা ছিঁড়তে। মাঝে মাঝে এমনিতেও যেতাম। এমনই একদিন বসে আছি রয়েল হাটে, ইরফান ভাই আর সাইফুল ভাইয়ের সাথে। এমন সময় সৌরভ এলো, ওনাদের সাথে সৌরভের পরিচয় করিয়ে দিলাম প্রথাগত সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে। মজার ব্যাপার, তাঁরা সেটাই সত্যি বলে ধরে নিলেন। সেদিন সৌরভকে অনেক অনুরোধ করলেন, গান শোনানোর জন্য। কোন এক অদ্ভুত কারণে, সেদিন সৌরভকে দিয়ে গান গাওয়ানো গেলোনা। গাইলো না যে গাইলোই না!
ফিরিঙ্গি বাজার ব্রিজঘাটে, কর্ণফুলীর তীরে সুমনের গানগুলো
সেই রয়েল হাট প্র্যাংক এর সমাধান হয়েছিলো কর্ণফুলীর তীরে। ফিরিঙ্গি বাজার ব্রিজঘাট অথবা অভয়মিত্র ঘাট, দুটোই আমাদের অত্যন্ত প্রিয় জায়গা ছিলো। প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকলেও মাঝে মাঝে চলে যেতাম কর্ণফুলীর বাতাসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে। আর সেই সাথে চলতো গান। এখানে এলে সৌরভ বেশি গাইতো কবীর সুমনের গান। দুজনে মিলে ধরতাম,
বাঁশুরিয়া, বাজাও বাঁশি, দেখি না তোমায়,
গেঁয়ো সুর ভেসে বেড়ায় শহুরে হাওয়ায়……
এটা বোধ করি, এই গানের বিশেষ একটা লাইনের জন্য গাওয়া হতো,
ঠ্যালা-ভ্যান চালাও তুমি, কিংবা ভাড়া গাড়ির ক্লিনার;
ক’বছরে একবার যাও, তোমার দেশে নদীর কিনার?
ফিরে এসে উদোম খাটো, গায়ে-গতরে ব্যস্ত হাতে;
মজুরিতে ভাগ বসাচ্ছে কারা তোমার কলকাতাতে?
কর্ণফুলীর ওপার থেকে খেটে খাওয়া হাজার মানুষের আগমনকে উৎসর্গ করেই হয়তো গাইতাম। অথবা, জাতিশ্বর, গানটার শেষের দিকে দুজনেই ইমোশনাল হয়ে যেতাম…….
যতবার তুমি জননী হয়েছো, ততবার আমি পিতা,
কত সন্তান জ্বালালো প্রেয়সী, তোমার আমার চিতা!
আমরা ছিলাম একে অপরের গানওয়ালা , একজন আরেকজনের উদ্দেশ্যে গাইতাম,
ও গানওয়ালা, আরেকটা গান গাও,
আমার আর কোথাও যাওয়ার নেই, কিচ্ছু করার নেই…
আমি থাকতাম হাই লেভেল রোডে, কিছুটা পাহাড়ী রাস্তা। পশ্চিম দিকের রাস্তা ধরে উঠতে থাকলে কর্ণেল হোটেলের মোড়, আরো ওপরের দিকে উঠে গেছে পশ্চিম হাই লেভেল রোড। একদিন ইচ্ছে হলো, দুজন মিলে রওনা দিলাম ঐ রাস্তা ধরে, একদম হুদাই। কিছুক্ষণ পরেই একটা সিঁড়ি আরো ওপরের দিকে নিয়ে গেলো। সেটা বেয়ে উঠতেই আবিষ্কার করলাম, আমরা একটা পাহাড়ের ওপরে উঠে গেছি, এখানে আশেপাশে বিল্ডিং নেই বললেই চলে। গান গাওয়ার জন্য আরকটা স্পট পেয়ে গেলাম আর কি!
এরপর থেকে প্রায়ই ওখানে চলে যেতাম, গিয়ে উদার গলায় গান গাইতাম। আর এখানে এলে চলতো রবীন্দ্রসংগীত আর শ্রীকান্ত। মানবেন্দ্র আর অখিল বন্ধু ঘোষকেও রেহাই দিতাম না। এমনই একবার শ্রীকান্তের গান গাইছি, একটু দূরের একটা বিল্ডিং এর বারান্দায় একটা মেয়ে এসে দাঁড়ালো। সন্ধ্যা হয়ে গেছে তখন, ঘরের আলো মেয়েটার পেছনে, চেহারা দেখা যায়নি, শুধু অবয়ব। আমাদের গান গাওয়া শেষ হলো, মেয়েটাও আবার ঘরের ভেতর ঢুকে গেলো। এই ঘটনা নিয়ে আমরা অন্তত দশ মিনিট বিভিন্ন ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছি, এবং আমরা যে কত উঁচুমানের শিল্পী, সেটা নিয়ে আত্মতৃপ্তি অনুভব করেছি!
আসলে গাইছি, এই ফ্যাক্টটাই বড় ছিলো আমাদের কাছে। কেমন গাইছি, সেটা ব্যাপার না। আসলে আমরা কেউই তো গায়ক নই। গানের বারোটা বাজাতাম আর নিজেরাই নিজেদেরকে নিয়ে “আরে, আমরা তো ভালো গাই” বলে কমেডি করতাম আর কি! তবু গাইতে ভালো লাগতো বলে গাইতাম। আরো কিছু টুকরো টুকরো স্মৃতি আছে, যেমন নেক্সটপের নতুন অফিসে খালি রুমের মধ্যে ইকোসহ গান গাওয়া, অথবা ওয়াসাতে মামুর দোকানে টেবিল বাজিয়ে গান গাওয়া, ইত্যাদি। কিন্তু সেগুলো ঠিক বলে বোঝানো যাবে না, আমি আর সৌরভ ছাড়া সেই ফিলিংসটা সহজে বুঝবে না কেউ।
শেষ করছি শুরু দিয়ে
একদম প্রথম যেদিন আমরা একসাথে গান গেয়েছিলাম, সেটার স্মৃতিটা বেশ মজার – সন্ধ্যার পর লোডশেডিং চলছিলো, রাস্তাতেও তেমন কোন আলো নেই। আশেপাশের বাসাবাড়ির জানালা দিয়ে সামান্য কিছু আলো, আর বাকীটা চাঁদের দয়া। রিকশায় করে আমি আর সৌরভ বাসায় ফিরছিলাম। উঁচু ঢাল বেয়ে শম্বুকগতিতে রিকশা চলছিলো, আর আমরা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছিলাম, ”আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন, তোমাতে করিবো বাস”……… দূর থেকে এক লোক আমাদের দিকেই আসছিলেন, হঠাৎ হাঁটার গতি কমিয়ে দিলেন। আমাদের রিকশা যখন ওনার প্রায় মুখোমুখি, এমন সময় বললেন, “তোমরা তো চমৎকার গাও, বাবা”
এটুকুই যথেষ্ট ছিলো, আমাদের গান আর কেউ থামাতে পারেনি। কিন্তু সাড়ে আট হাজার মাইল দূরত্ব পেরেছে…… ইসস, কতদিন একসাথে গান গাই না!