
২০০৭ সালে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচালকের জন্য একটা ভোটের আয়োজন করলো Total Magazine. সেই তালিকায় সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে প্রথম হয়েছিলেন আলফ্রেড হিচকক। তালিকার দ্বিতীয় ব্যক্তিটি কিন্তু তাই বলে হারেননি। কারণ, হিচককের কাছে হারা আসলে হার নয়। এটুকু সত্য, এখনো বেঁচে আছেন, এমন পরিচালকদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছেন মার্টিন স্করসেজি। একসময় তিনি নাকি যাজক হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রবার্ট ডি নিরো’র মতে, সেটার চেয়ে অধিক উপযুক্ত কাজটা করেছেন স্করসেজি, হয়েছেন মুভি জগতের High Priest. মুভি জগতের সর্বোচ্চ শিরোমণিকে নিয়েই আজকের এই গল্প ফেঁদে বসা।
প্রিয় মুভির তালিকা করতে বসলে প্রথম ৩০টার মধ্যে প্রায় ১০টা স্করসেজি পরিচালিত মুভি থাকবে – The Aviator, Taxi Driver, Raging Bull, The Departed, Goodfellas, Gangs of New York, Shutter Island, Silence, ইত্যাদি। মানে, প্রথম ৩০টার ৩ ভাগের ১ ভাগ স্করসেজির, বাকি ৬৬% দুনিয়ার বাকি সব পরিচালক মিলিয়ে। এতোটাই পছন্দের পরিচালক তিনি আমার কাছে। এবং হয়তো আরো অনেকের কাছেই।
অস্কার, বাফটা, আর গোল্ডেন গ্লোব মিলিয়ে যিনি নিজের জন্য এবং তার সাথে কাজ করা অভিনেতাদের জন্য নিয়ে এসেছেন মোট ৫৪টা পুরষ্কার এবং ৩৭১টা নমিনেশন, তাকে জীবন্ত কিংবদন্তী বলতে কোনো আপত্তি থাকার কথা না। আর এটা তো শুধু অভিনেতাদের কথা বললাম, অন্যান্য সেক্টরের কথা বাদই দিলাম। আর ব্যক্তিগত কত মুকুট যে তিনি পরেছেন, তার জন্য রীতিমত গবেষণা করতে হবে।
জন্ম ও শৈশব
স্করসেজির জন্ম হয়েছিলো ১৯৪২ সালের নভেম্বরের ১৭ তারিখে। বাবা-মা দুজনেই গার্মেন্টসে কাজ করতেন। আবার দুজনেরই শখ ছিলো অভিনয়ের দিকে। এটার সাথে যুক্ত হলো এমন একটা বিষয় যেটাকে আমি ইতিবাচক বা নেতিবাচক কিছুই বলতে পারছি না। ছোটোবেলায় মার্টিনের বেশ ভালো অ্যাজমার সমস্যা ছিলো। তিনি খেলাধুলা করতে পারতেন না, ছুটোছুটি করতে পারতেন না। এজন্য বাবা-মা তাকে নিয়ে যেতেন থিয়েটারে। শারীরিক সমস্যাকে নেতিবাচক বলতে পারছি না এই কারণে যে, এখান থেকেই সিনেমার প্রতি মার্টিনের অন্তরঙ্গ সম্পর্কের শুরু। ঐ অ্যাজমা যদি না হতো, তাহলে কি এভাবে সিনেমায় ডুবে যেতে পারতেন তিনি? এরপর প্রচুর সিনেমা দেখেছেন তিনি, এবং তাদের কাজের প্রতি কৃতজ্ঞতাও স্বীকার করেন।
ক্যারিয়ারের প্রথম ১০ বছর
ইংরেজিতে অনার্স করার পর চারুকলাতে মাস্টার্স করার সময় থেকেই তিনি শর্ট ফিল্ম বানানো শুরু করেছিলেন। এরপর মাত্র ২৫ বছর বয়সে তিনি পরিচালনা করলেন তার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। প্রথমে ভিন্ন একটা নাম থাকলেও পরবর্তীতে আমরা যে টাইটেলটা পেয়েছি, তা হলো Who’s That Knocking at my Door. কেমন হয়েছিলো সে সিনেমাটা? ছোট্ট একটা তথ্য, পরের বছর শিকাগো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বিজয়ী সিনেমাটার নাম আন্দাজ করুন। আবার জিগায়!
১৯৭৩ সালে তিনি জুটি বাঁধলেন রবার্ট ডি নিরো’র সাথে, মুক্তি দিলেন Mean Streets. বলা যায়, মুহূর্তের মধ্যেই দর্শক এবং সমালোচকদের চোখে পড়ে গেলেন স্করসেজি। অভিনেতা+পরিচালক জন ক্যাসাভেট তাকে উৎসাহ দিয়ে বললেন, “নিজের যেমন খুশি, তেমন সিনেমা বানাও, প্রযোজকের কথা মত সিনেমা বানিও না।” – স্করসেজি আর ডি নিরোর এই জুটি চলবে আরো অনেক মুভিতে, এবং দুজনকেই এনে দেবে জগতজোড়া সাফল্য।
১৯৭৪, স্করসেজি মুভির প্রথম অস্কারের বছর। অভিনেত্রী এলেন বার্স্টিন কী দুর্দান্ত অভিনয় দেখালেন! এটা ছাড়াও আরো তিনটা বাফটা পুরষ্কার পেয়েছিলো Alice Doesn’t Live Here Anymore.
পরবর্তী মুভিটা পরিচালকের জীবনে একটা মাইলফলক হয়ে থাকবে। এটা দিয়ে সেই পরিচালককে সংজ্ঞায়িত করা হবে। এবং এই মুভি দিয়ে চলচ্চিত্রে একটা নতুন স্টাইল যুক্ত হবে – “স্করসেজি স্টাইল”। ছবির নাম Taxi Driver. রবার্ট ডি নিরোর ডেডিকেশন, জুডি ফস্টারের মায়া, এক্সপেরিমেন্টাল এডিটিং, আর সবকিছুর ওপরে – অনন্য Visual Literacy. আমার মনে হয় না, অন্য কোনো পরিচালক কখনো এই ভিজ্যুয়াল লিটারেসি জিনিসটাকে স্করসেজির চেয়ে ভালোভাবে ধরতে পেরেছেন। সিনেমাটোগ্রাফি জিনিসটা এই সিনেমাতে এসে একটা নতুন মাত্রা পেয়েছিলো বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। উনি বলেছেন, “ছোটোবেলায় বাসায় পড়ালেখার কোনো চর্চা ছিলো না, তখন বেশির ভাগ জিনিসই ছিলো ভিজ্যুয়াল। তখন আমি বুঝতে পারিনি, কিন্তু আমি ভিজ্যুয়াল লিটারেসি জিনিসটা শিখছিলাম”। ভিজুয়াল লিটারেসি নিয়ে ওনার দশ মিনিটের ভিডিওটা দেখে নিতে পারেন।
পরবর্তী মুভিগুলো
Raging Bull – আবার রবার্ট ডি নিরো, আবার আকাশছোঁয়া সফলতা। জেইক লামাটা নামক বক্সারের জীবন নিয়ে বানানো মুভিটা কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয়কারী ডি নিরোর জন্য অস্কার নিয়ে এলো। Classic level of art, this movie was! মুগ্ধ হয়ে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত দেখেছি।
The Last Temptation of Christ – প্রথমে মনে হচ্ছিলো, সাধারণ কোনো “ক্রাইস্ট মুভি” হবে। কিন্তু, ভরসা রাখুন মার্টিন স্করসেজির ওপর। লেখক পল শ্রেডারের সাথে বেশ কয়েকবার কাজ করেছেন মার্টিন, এবং দুজনে মিলে একটা ভিন্নধর্মী মুভি তৈরি করলেন।
Goodfellas – অনেকে এখনো এটাকে স্করসেজির সেরা কাজ বলে থাকেন। অনেক অনেক সমালোচকের মতে, “অর্গানাইজড ক্রাইম নিয়ে এর চেয়ে ভালো আর মুভি আর তৈরি হয়নি, এমনকি গডফাদারও না।” এই মুভিটা অস্কার না পাওয়াতে হৈ চৈ শুরু হয়ে গিয়েছিলো পুরো হলিউড মুভি জগতে (শুধু Joe Pesci সাপোর্টিং রোলের জন্য অস্কার পেয়েছিলেন)। ঐ বছর যেটা আসলেই অস্কার পেয়েছিলো, সেই Dances with Wolves কে অস্কার পাওয়া অন্যতম বাজে মুভি বলা হয়। এই ঘৃণাটা বোধ করি গুডফেলাসকে না দেয়ার কারণেই। অবশ্য অস্কারের চেয়ে বড় জিনিসটা স্করসেজি পেয়ে গিয়েছিলেন, মানুষের ভালোবাসা; ক্রিস্টোফার নোলান আর লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও এর মতই।
২১ শতাব্দী এবং লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিওর সাথে জুটি
ড্যানিয়েল ডে লুইসের সাথে Age of Innocence, ডি নিরোর সাথে আরো দুটো মুভি (Cape Fear আর Casino) বানানোর পর, আরো একবার ড্যানিয়েল ডে লুইসকে সাথে নিলেন স্করসেজি। আর এবার তার আখড়ায় এলো আরেক কুস্তিগীর। এই কুস্তিগীর সামনের দিনগুলোতে হেভিওয়েট বলে প্রমাণিত হবে। তার নাম লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়কার কাহিনী নিয়ে বানানো এই মুভির নাম Gangs of New York. ড্যানিয়েল ডে লুইস তো জাত অভিনেতা, আর লিওনার্দোও ততদিনে (২০০২ সালে) বেশ প্রশংসিত! সিনেমার ব্যাপক প্রশংসার পাশাপাশি এটার একটা সমালোচনা ছিলো যে এটা নাকি অনেকগুলো থিম নিয়ে কাজ করেছে, এবং কোনোটাকেই একদম আলাদা করে তুলে আনতে পারেনি। এটার একটা কারণও ছিলো। সিনেমাটার দৈর্ঘ্য আড়াই ঘণ্টার কিছু বেশি হলেও কাহিনীর যে ব্যাপকতা, তার কাছে একদম ছোটো। কথা সত্য! তাই, ২০১৩ সালে যখন এটার ওপর ভিত্তি করে টেলিভিশন সিরিজ বানানোর কথা উত্থাপিত হলো, তখন খুশি আর কাকে বলে!
২০০৪ সাল, The Aviator.
প্রথমবার আমি এই মুভিটা দেখি ২০০৫ সালে, আমার বয়স তখন ১৯। আমি একটা ধাক্কা খেলাম। ইংরেজি মুভি দেখা শুরু করার পর থেকে আমার কখনো কোনো মুভি দেখে মনে হয়নি, আমি এই মুভির উপযুক্ত না। এভিয়েটর দেখে মনে হলো, এই মুভির নির্যাস আমি নিতে পারছি না। এটা ভালো মুভি নাকি খারাপ মুভি (আমার ভালো লেগেছে নাকি খারাপ লেগেছে), সেটাও বুঝতে পারছিলাম না। শুধু মনে হচ্ছিলো, এই মুভির ব্যাপারে মন্তব্য করার মত বয়সই আমার হয়নি। আমি বড় হওয়ার অপেক্ষায় রইলাম।
৬ বছর পর, ২০১১ সালে, বন্ধু সালমান সহ মুভিটা আবার দেখলাম। উত্তেজনায় থমথম করা একটা মুভি, এবং PURE CLASS অবলোকন করলাম। তখন থেকে লিওনার্দোর অভিনীত এবং/অথবা স্করসেজির পরিচালিত সবচেয়ে প্রিয় মুভি THE AVIATOR. এটা নিয়ে একটা রিভিউ লিখেছিলাম, Aviator Review.
2006, The Departed
আরো একবার অর্গানাইজড ক্রাইম নিয়ে এলেন তিনি, এবং আবারো বাজিমাত। অন্যদেরকে অস্কার এনে দিলেও তার নিজের কপালে এই প্রথম নিজের জন্যে পুরষ্কারটা ছিনিয়ে নিলেন স্করসেজি, পাশাপাশি বেস্ট মুভি, । ম্যাট ডেমন, মার্ক ওয়ালবার্গ, এর পাশাপাশি আরো একবার ফাটিয়ে দিলেন লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও। স্করসেজি কখনোই জটিল স্ক্রিপ্ট নিয়ে কাজ করতে পিছপা হননি। পাশাপাশি, মানবিক দ্বিধাগুলোও দেখাতে দ্বিধা করেননি। কী অদ্ভুত এক পরিস্থিতি তিনি তৈরি করেছিলেন এই মুভিতে, না দেখা থাকলে চরম দেড়শো মিনিট কাটানোর জন্য বসে যান।
2010, Shutter Island
মাঝে বেশ কিছু সময় নিয়ে বানালেন এই মুভিটা। এই সিনেমাটাকে নতুন একটা জনরা’র প্রথম মুভি বলে অনেকে, আর সেই জনরা’টা হলো Techno Horror. থ্রিলারের মধ্যে আতংকের মিশ্রণ নিয়ে এর আগে ডি নিরোর সাথে Cape Fear বানিয়েছিলেন স্করসেজি। আর এইবার তিনি আরো অনেক বেশি পরিণত, আরো বেশি দক্ষ। ফলাফল, Shutter Island হয়ে গেলো তরুণ মুভিখোরদের কাছে অবশ্য ভক্ষণীয় খাদ্য।
সমালোচকরা ততদিনে স্করসেজির কাছ থেকে ঐশ্বরিক মাত্রার সৃষ্টি আশা করে বসে আছেন। তাদের অতিরঞ্জিত উৎসাহকে সন্তুষ্ট করতে পারেননি তিনি। সবার সমালোচনার মূল সূত্র একটাই – স্করসেজি নিজের জন্য যে উচ্চতা তৈরি করেছেন, এটা নাকি সেটার সাথে যায় না। তাহলে আমার প্রশ্ন, “অন্য কেউ এই মুভি বানালে কি তাহলে প্রশংসা করে ভাসায়ে ফেলতেন?” আশ্চর্য!
এরপর নিজের কমফোর্ট জোনের বাইরে গিয়ে ভিন্নধর্মী মুভি Hugo বানিয়ে মার্টিন প্রমাণ করলেন, আসলে তার মধ্যে কমফোর্ট জোন বলতে কিছু নেই। সবকিছুতেই তিনি সমান কমফোর্টেবল। এটাতে লিও ছিলো না, তাই ওপরের শিরোনামের নিচে এটা আসে না, তবে এটা নিয়ে একটা শর্ট রিভিউ লিখেছিলাম, পড়ে দেখতে পারেন।
পরের মুভিটা আবারো লিওকে নিয়ে, The Wolf of Wall Street. একই সঙ্গে অনেক জনরার মধ্যে ফেলা চলে এই মুভিটাকে – পিরিয়ড মুভি, ব্ল্যাক কমেডি মুভি, বায়োগ্রাফিক্যাল মুভি, ড্রামা, এবং আবারো ক্রাইম মুভি। ক্ল্যাসিক স্করসেজি স্টাইলের স্ক্রীনপ্লে, গ্ল্যামার, স্টাইল, নগ্নতা, নেশা (ড্রাগস ও টাকা দুটোরই), হিউমার, থ্রিল এর কমপ্লিট প্যাকেজ ছিলো এই মুভিটা। অভিজ্ঞ লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিওর পাশাপাশি চুটিয়ে অভিনয় করেছে মার্গট রবি। হৃদয় জুড়োনো সুন্দরী দেখলাম হলিউডের জগতে অনেক, অনে……ক বছর পর।
লিওনার্দোর সাথে মুভিগুলো নিয়ে কথা বলছিলাম। মাঝখানে আরেকটা প্রিয় মুভির আলোচনা ঢুকিয়ে দিই। মুভিটা ২০১৬ সালের, Liam Neeson এর সাথে, Silence. লিয়াম আগেও কাজ করেছেন ওনার সাথে, Gangs of New York এর মধ্যে। এবার একদম মূল চরিত্রেই এলেন লিয়াম। স্করসেজির পরিচালনার ব্যাপারে তিনি সম্প্রতি একটা ইন্টারভিউ দিয়েছেন, সেখানে তিনি বলেছেন, “মার্টিন স্করসেজির সাথে কাজ করার অফার ফিরিয়ে দেবার সাহস কার আছে? উনি খুবই সম্মানিত একজন পরিচালক এবং অভিনেতাদের দিকেও তিনি একদম আলাদা। তার মত মনযোগ এবং মূল বিষয়ে ঢুকে যাওয়ার ক্ষমতা, অভিনেতাদের জন্য সেটের মধ্যে তিনি যা তৈরি করে রাখেন, এক কথায় অনন্য। অবশ্য এই উত্তেজনার সাথে নিজের কাছ থেকে কিছুটা প্রত্যাশাও থাকে। মার্টিনকে সবাই ভয় পায়। উনি একজন কিংবদন্তী – আর একজন অভিনেতা হিসেবে এই জিনিসটা মেনে নিয়ে সেটা কাটিয়ে উঠতে হবে। আমাকেও কাটিয়ে উঠতে হয়েছে। তিনি সেটের মধ্যে নিশ্ছিদ্র নীরবতা চেয়েছেন (সিনেমার নামও Silence); এমন নীরবতা যে যখন তিনি নির্দেশনা দিচ্ছেন বা কোনো দৃশ্য বুঝিয়ে দিচ্ছেন, তখন অন্য কেউ অন্য কোনো কাজ করতে পারবে না। কেউই না, মানে ৪০০ গজ দূরে যে লোকটা আঁকাআঁকি করছে, ওকেও থেমে যেতে হবে। একটা ছোটো শব্দ শুনলেও ব্যাপারটা তার জন্য ভেস্তে যায়, এবং তিনি এই সম্মানটুকু আদায় করে নেন। তিনি সেই নীরবতার কড়া আদেশ দিয়েছেন, এবং এই সিনেমার জন্য এটা বেশ জরুরি ছিলো।”
এই সিনেমাটা আমার মনে এত গভীর দাগ কেটেছে যে, এটা নিয়ে গোটা একটা রিভিউ পয়দা করে বসেছি। তাও আবার দুই ভাষায় – বাংলা আর ইংরেজিতে।
2023, Killers of the Flower Moon
মার্টিন স্করসেসিকে ১৯৯০ সালে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, উনি কখনো ওয়েস্টার্ন বানালে সেটা দেখতে কীরকম হবে? ৩৩ বছর পর, সেটা দেখার সুযোগ হলো দর্শকদের। তার নতুন সিনেমা Killers of the Flower Moon এলো ২০২৩ সালে, তার বানানো প্রথম ওয়েস্টার্ন মুভি।
উনি নিউ ইয়র্ক শহরে বড় হয়েছেন, তাই ছোটোবেলায় ওনার মনে হতো খোলা জায়গা, ঘোড়া, এগুলো হয়তো ওনার কখনোই সামনাসামনি দেখা হবে না। তাই, এগুলো নিয়ে একটা ফ্যান্টাসি তৈরি হয়েছিলো। ওয়েস্টার্ন মুভি অনেক পছন্দ করতেন উনি। উনি আকারে ছোটোখাটো মানুষ। লম্বা, সুঠাম দেহের অধিকারী ওয়েস্টার্ন নায়কদেরকে যখন প্রতিকূল পরিবেশে কষ্ট করে টিকে থাকতে দেখতেন, সেটাও একটা ফ্যান্টাসি তৈরি করেছিলো ওনার মধ্যে।
উনি বলেছিলেন, কখনো ওয়েস্টার্ন বানালে অতি-বাস্তবের বদলে পৌরাণিক স্কেলে কিছু বানাবেন। উনি নাকি চরিত্রগুলো নিয়ে বেশি আগ্রহী। একটা নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে একটা ওয়েস্টার্ন চরিত্র কেন অমুক সিদ্ধান্ত নিলো, এটা তার মুভিতে উঠে আসবে। প্রত্যেক মুহূর্তে জীবন-মৃত্যুর টানাপোড়েন উঠে আসবে ওনার ওয়েস্টার্নে। কিন্তু কিলার্স অফ দ্যা ফ্লাওয়ার মুন সত্যি ঘটনার ওপরে ভিত্তি করে বানানো, পৌরাণিক স্কেলের চেয়ে বাস্তবতাই বেশি উঠে আসবে এখানে, এমনটাই আন্দাজ করেছিলাম।
সিনেমা দেখার প্রস্তুতি হিসেবে বইটা পড়ে ফেলেছিলাম। আর কোনোভাবেই এটা বুঝতে পারছিলাম না যে এরকম একটা ডকুমেন্টারি টাইপ বই থেকে কিভাবে এরকম মুভি বানানো সম্ভব। জ্বি হ্যাঁ, কিলার্স অফ দ্যা ফ্লাওয়ার মুন বইটা কোনো উপন্যাস নয়; স্রেফ ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর ধারা বিবরণী। সাধারণত কোনো বই পড়তে গেলে স্ক্রিনপ্লে বা চিত্রনাট্য চোখের সামনে ভাসে। আর এটা পড়তে গিয়ে শুধু মনে হয়েছিলো – this is going to be a screenplay nightmare. ভাবছিলাম – শুধু এটুকু জানি, যদি কেউ পারে, তাহলে একমাত্র স্করসেসিই পারবে এটাকে মুভি বানাতে।
এবং তিনি পেরেছিলেন। মুভি থিয়েটারে আসার আগে ক্যান মুভি ফেস্টিভ্যালে প্রথমে স্পেশাল স্ক্রিনিং হয়েছিলো, তখনই রটেন টমেটোতে রেটিং চলে এসেছিলো – ৯৭% ফ্রেশ। স্করসেসির সাথে ৩ ঘণ্টা ২৬ মিনিট কাটানোর জন্য অপেক্ষা করলাম আরো তিন মাস, অক্টোবর পর্যন্ত। আর শেষ পর্যন্ত অদ্ভুত আবেগে ভেসে গেলাম।
********
তার সিনেমাগুলো নিয়েই প্রধানত আলাপ করলাম। সিনেমাসত্তার পাশাপাশি ব্যক্তিসত্তার ব্যাপারে তার সাথে কাজ করা লোকগুলো কী বলে, জানতে চাইলে 25th AFI lifetime achievement award অনুষ্ঠানের ভিডিওগুলো দেখতে পারেন। তার ব্যাপারে ছোটো কিছু তথ্য দেয়ার লোভ সামলাতে পারছি না –
১) তার সবচেয়ে প্রিয় মুভিগুলো হচ্ছে 2001: A Space Odyssey, 8½, Ashes and Diamonds, Citizen Kane, The Leopard, Paisà, ইত্যাদি।
২) তিনি মোট ৫ বার বিয়ে করেছেন।
৩) ২০০৭ এ টাইম ম্যাগাজিনের ১০০ সর্বোচ্চ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে তার নামও ছিলো।
৪) তার দাদা-দাদী, নানা-নানী, দুজনেই ইতালির সিসিলি থেকে এসেছিলেন। মাফিয়াদের সাথে সিসিলির সম্পর্ক তো বোঝেনই। তার মধ্যে ক্রাইম মুভি বানানোর অনুপ্রেরণা কি কোনোভাবে এটার সাথে জড়িত?
৫) The Film Foundation নামে একটা নন-প্রফিট সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি, যার কাজ ক্ল্যাসিক ফিল্মগুলোকে সংরক্ষণ করা। ১৯৫০ এর আগের অর্ধেক মুভি নষ্ট হয়ে গেছে, ১৯২৯ এর আগের ৮০% মুভিই হারিয়ে গেছে। সেগুলোকে খুঁজে বের করা, পুনরায় দেখার উপযোগী করে তোলা, এবং সংরক্ষণ করবে এই সংগঠন। এটার বোর্ড অফ ডিরেক্টরসের মধ্যে ক্রিস্টোফার নোলানও যোগ দিয়েছেন বলে শুনেছি।
প্রিয় পরিচালক আরো অনেকে আছেন। একটু আগেই নোলানের কথা বলছিলাম। নোলানকে অনেকে স্করসেজির উত্তরসূরী মনে করেন। নোলানের কাজের মধ্যে তার প্রভাব খুঁজে পেতে খুব একটা কষ্ট হয় না। তবে স্করসেজির যেই উচ্চতার কথা বলছিলাম, সেটা শুধু কয়েক ম্যাচে সেঞ্চুরি করা থেকে আসবে না। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে চরম ব্যাটিং এভারেজ দেখাতে পারলে তবেই সেটা সম্ভব। আর, অর্ধ শতকের বেশি সময় ধরে সিনেমা বানিয়ে প্রায় সবগুলোতেই এ ধরনের পারফরম্যান্স দেখানো ক্যারিয়ার বগলদাবা করা কোনো চাট্টিখানি কথা না।