The Handmaid’s Tale সমাচার

হ্যান্ডমেইডস টেইলের কাহিনী এমন একটা নৈরাজ্যপূর্ণ ভবিষ্যতের যেখানে নারীদের কোনো স্বাধীনতা নেই, কোনো বিচার ব্যবস্থা নেই, স্বৈরাচারী সরকার নিজেদের মতাদর্শ চাপিয়ে দিয়েছে সবার ওপর। সিরিজটা দেখতে দেখতে অনেকেরই মস্তিষ্কে চাপ পড়ে, অনেকেই তীব্র যন্ত্রণাও অনুভব করেন, এসব কথা নিশ্চয়ই অনেকে বলেছে। আমি আর এই ব্যাপারে আমার অনুভূতি বয়ান করে আর কথা বাড়ালাম না। আমি বরং অন্য কিছু বলার চেষ্টা করি।

যখনই মানবজাতি কোনো ক্রাইসিসের মুখোমুখি হয়, তারা তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে এমন কিছু সিদ্ধান্ত নেয়, যেটা ওই সময়ে অনেকের কাছে উপযুক্ত মনে হয়। তাই, ওরা মনেপ্রাণে সেই সমাধানটাকে আঁকড়ে ধরে। যেমন, প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যে যখন যুদ্ধ দোরগোড়ায় এসেছিলো, তখন ওরা গণতন্ত্র তুলে দিয়ে সিজারের ক্ষমতায়ন জারি করেছিলো। একবিংশ শতাব্দীতে টুইন টাওয়ার হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র একাধিক দেশ আক্রমণ করে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করেছে। এরকম আরো অসংখ্য উদাহরণ আছে, যেখানে সমস্যার দ্রুত সমাধান খুঁজতে গিয়ে হাজার হাজার মানুষকে বলি হয়ে যেতে হয়েছে। এ ধরনের দ্রুত সমাধান যে কখনোই দীর্ঘকালীন সুফল বয়ে আনে না, সেটার জন্য ইতিহাস সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

হ্যান্ডমেইডস টেইলও এমন একটা সমস্যা দেখায় (উর্বরতা কমে যাচ্ছে), কেউ কেউ সেটার দ্রুত সমাধান খোঁজে (নারীর দায়িত্ব সন্তান জন্ম দেয়া এবং কেউ গর্ভধারণ করতে না চাইলে তাদেরকে সেটা করতে বাধ্য করা, অর্থাৎ তাদেরকে হ্যান্ডমেইডে পরিণত করা, বিশেষ করে যারা এই নীতির বিরুদ্ধাচারণ করেছে), একটা দল অত্যন্ত আবেগ নিয়ে এই মতাদর্শ ধারণ করে (অর্থাৎ, একটা cult তৈরি করে), এবং এটার বাস্তবায়নের জন্য সবকিছু বাজি ধরে (এমনকি সামরিক ক্যু পর্যন্ত)। এবং শেষ পর্যন্ত, দ্রুত সমাধানের কারণে সমাজে নেমে আসে ধারণার অতীত দুর্ভোগ। সিরিজে বলা হয়, “ভালো আসলে সবার জন্য ভালো না”। কিন্তু দ্রুত সমাধানের পথ কখনোই সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য ভালো হয় না।

একটা দৃশ্যে প্রধান চরিত্র জুন ( এলিজাবেথ মস) বলছিলো, কিছুই একদিনে পাল্টায় না, দীর্ঘদিন ধরে অনেকে সব দেখেও চুপ করে থাকে বলেই পরিস্থিতির এরকম অবনতি হয়। ইস, কথাটা যে কী নির্মম সত্য! এর চেয়ে যন্ত্রণাদায়ক সত্য মনে হয় এই সিরিজে আর একটাও ছিল না। হিটলারও একদিনে তৈরি হয়নি, তালেবানও না; আর বাংলাদেশের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতাও একদিনের ফলাফল নয়। সেই বঙ্গভঙ্গের সময় থেকেই হিন্দু-মুসলিম রেষারেষি তৈরি হয়েছিলো, মুক্তিযুদ্ধের সময়েও পাকিস্তানি সেনারা রাস্তায় দাঁড় করিয়ে কলমা জিজ্ঞেস করতো। ঐ সময়গুলোতে আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম, রাস্তায় নেমেছিলাম, যুদ্ধ করেছিলাম। কিন্তু সারা বাংলাদেশে গ্রামে-গঞ্জে-শহরের ওয়াজ মাহফিলে যখন কাফেরদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করা হয়, আমরা কিন্তু কিছু বলিনি, চুপ করে থেকেছি। মাদ্রাসাগুলো থেকে যখন এলাকার সেক্যুলার অনুষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে, আমরা চুপ করে থেকেছি। অবশেষে হুমায়ুন আজাদকে হত্যা করা হলো, শামসুর রাহমানের বাসায় হামলা করা হলো, আমরা রাস্তায় নেমে আসিনি। বছরের পর বছর ধরে, অসংখ্য ঘটনায় আমাদের নীরবতাকে কাজে লাগিয়ে আজ ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা এই জায়গায় এসে পৌঁছেছে। এখন নাস্তিক হওয়ার কারণে প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হয়ে যাওয়াটা এতটাই স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে যে খুনী ধরা পড়লেও বিচারের আগেই জামিন পেয়ে যায়।

সিরিজের আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে বিনা বিচারে সাজা শুনানি। আপনার কাজ পছন্দ হলো না, দুম করে রাস্তায় গুলি মেরে ফেলে দেয়া হলো, অথবা সবাইকে ভয় দেখানোর জন্য ঝুলিয়ে রাখা হলো দিনের পর দিন। এটা যে শুধু কল্পনা, তা না কিন্তু। সৌদিআরবে এমনটা অহরহ হচ্ছে। কয়েকদিন আগে একটা ভিডিও দেখলাম যেখানে এক পুরুষ তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে যে স্ত্রীটি নাকি তাদের মেয়েকে মেরে ফেলেছে। মহিলা চিৎকার করে বলার চেষ্টা করছেন, “আমি মারিনি, আমি মারিনি, আমি নির্দোষ”। কিন্তু তার কথা শোনার কেউ ছিলো না। সাদা আলখাল্লা পরা এক লোক তলোয়ার নিয়ে খপ করে মহিলার কল্লা ফেলে দিলো। কোনো প্রমাণের বালাই নেই, কোনো বিচারক নেই, সরাসরি সাজা। বাংলাদেশেও এই চর্চা আসলে বহু পুরনো। ১৯৭৩ সালে চরমপন্থী দমনের জন্য তৈরি রক্ষীবাহিনী থেকে শুরু করে, ২০০১ সালে অপারেশন ক্লিনহার্ট, ২০০৩ সালে র‍্যাব – এসবই খোদ সরকারের মাধ্যমে তৈরি হওয়া বিচারবিহীন হত্যার মেশিন। আমরা কখনোই একযোগে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসিনি। অনেকেই মনে করেছে, এটাই তো দ্রুত সমাধান! এত এত মামলা আদালতে জমা পড়ে আছে, কবে এগুলোর রায় হবে, কবে এরা সাজা পাবে, আদতে সাজা পাবে কিনা, উপযুক্ত বিচার হবে কিনা, এই সন্দেহ থেকে মুক্তির দ্রুত সমাধান হিসেবে অনেকে ক্রসফায়ারকে সাধুবাদও দিয়েছে। অথচ, এই সাপ যে শেষকালে সবাইকে কামড়াতে আসবে, সেটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নাই, ইতিহাস সাক্ষী!

সিরিজের সবগুলো কলাকুশলী অসাধারণ কাজ করেছে, বিশেষ করে জুনের চরিত্রে এলিজাবেথ মস আর সেরেনার চরিত্রে ইভন স্ত্রাভস্কি ফাটিয়ে দিয়েছে একদম। এই দুটো চরিত্রের বিকাশের গল্প দেখাতে গিয়েই মূল গল্পটা আস্তে আস্তে ফুটে উঠছে। অনেক অনেক ব্যাকস্টোরি (ফ্ল্যাশব্যাক) দেখানো হয় এই শোতে, যেন এই চরিত্রগুলোর সবাই দুটো জীবনযাপন করছে, কঠিন পূর্বে এবং আরো কঠিন বর্তমানে। খুব অমিল এই দুই সময়ের মধ্যে, আবার খুব মিলও আছে। জুন এই দুই সময়ের পার্থক্য আর মিলের দ্বন্দ্বে পড়ে থাকে। এই চরিত্রে এলিজাবেথ মস ছাড়া আর কাউকে ভাবতেই পারছি না। ওর অভিব্যক্তিগুলো এত যথার্থ! শুধু ওর চেহারার দিকে তাকালেই পরিস্থিতির আঁচ পাওয়া যায়। প্রথম সিজনে মনে হয়েছিল, ওর চেহারাটাই বুঝি ভীতু টাইপ। পরের সিজনের শুরুতে দেখলাম, ওর দৃঢ়তা মেশানো চেহারা। আস্তে আস্তে বুঝলাম, she is a face artist, আগেকার যুগের প্রতাপশালী অভিনেত্রীদের মত, যখন স্পেশাল ইফেক্টের চেয়ে ভিজ্যুয়াল সূত্র দিয়ে কাহিনী বোঝানো হতো, তেমন শক্তিশালী ওর অভিনয়।

এই সিরিজটা নিয়ে Nerdwriter একটা ভিডিও বানিয়েছিলো; বিশ্লেষণটা মূলত এই সিরিজের shallow depth of field এবং এটার প্রভাব নিয়ে ছিলো। এটার কারণে শুধু একটা ছোট্টো জিনিস ফোকাসে থাকে, আর বাকি সব ঘোলাটে হয়ে যায়। এবং সিরিজের এই জিনিসটা আসলেই আমাকে মারাত্মক আলোড়িত করেছে। বাকি সব ঘোলাটে! দৃষ্টির সীমাবদ্ধতা! 

হ্যান্ডমেইডদের পোশাকের একটা অংশ হচ্ছে মাথার বড় ঢাকনাওয়ালা টুপিটা। এটা যে পড়বে, তার দৃষ্টিও সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাদেরকে আশেপাশে দেখতে দেয়া হয় না, তাদেরকে তোতাপাখির মত কিছু মুখস্থ বুলি ছাড়া আর কিছু বলতেও দেয়া হয় না। তাদেরকে পড়তে দেয়া হয় না, লিখতে দেয়া হয় না, নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে কোথাও যেতেও দেয়া হয় না। চোখ যত খুলবে, জ্ঞান যত বাড়বে, স্বাধীনতার তৃষ্ণাও তত বাড়বে। তাই, পরাধীন করে রাখার জন্য দৃষ্টিসীমা সংকুচিত করে রাখার চেয়ে ভালো উপায় আর হয় না। বাংলাদেশেও কি ইদানিং সেটারই একটা প্রোটোটাইপ চলছে না? একদিকে নারীকে পারিবারিক দিক থেকে নির্দিষ্ট পোশাক পরতে চাপ দেয়া হচ্ছে, অন্যদিকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চাকে হেয় করা হচ্ছে। আমার নিজেরই এক মামার মতামত হচ্ছে, বেশি পড়াশোনা করলে নাকি পোলাপাইন বখে যায়, এজন্য উনি চান না যে ওনার ছেলেমেয়ে বেশি পড়ালেখা করুক। সকলের প্রতিবাদ স্বত্ত্বেও বড় মেয়েকে বেশ অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন; ছেলেকে মাদ্রাসায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, যদিও সে ওখান থেকে পালিয়ে এসেছে।

সিরিজটা নিয়ে Nerdwriter এর বিশ্লেষণে (অন্যান্য অনেক কিছুর পাশাপাশি) একটা কথা বলা হয়েছিলো – আমাদের অধিকারগুলো সুরক্ষিত নয়, এমন কোনো গ্যারান্টি নেই যে এই দুনিয়া আমাদের অধিকারগুলোকে সমুন্নত রাখবে; সেগুলোর জন্য আমাদেরকে লড়াই করতে হয়। কারণ, যদি আমরা আমাদের ফোকাসের বাইরের দুনিয়াটাকে না দেখি, তাহলে সেই অধিকারগুলোকে কেড়ে নেয়া যেতে পারে।

অনেকেই হয়তো জানেন না, যুক্তরাষ্ট্রে মহিলাদের গর্ভধারণজনিত উর্বরতা আসলেই অনেক কমে গেছে। গত দুই বছরে ফিমেল ফার্টিলিটি ছিলো সর্বনিম্ন। হ্যান্ডমেইডস টেল এই সমস্যাটার একটা অতিরঞ্জিত সংস্করণ দেখাচ্ছে, এবং এও দেখাচ্ছে যে দ্রুত সমাধানের পথে এগোলে কী হতে পারে। আশা করি, বাংলাদেশ তার এই অবস্থার সঠিক সমাধান খুঁজবে, সমাধানটা ধীর গতির হলেও। আর সেটার জন্য আমাদের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে, লড়াই করতে হবে।

Share:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *