আজ থেকে ঠিক ১৩ বছর আগে প্রথমবার আমেরিকার মাটিতে পা রেখেছিলাম। মাঝখানে এক বছর দেশে কাটিয়েছি, তাই… হিসেবে বরাবর এক দশক সময় ধরে আমেরিকাতে আছি। জীবন সবসময় একরকম যায় না। কত ওঠা-নামা দেখলাম এই তের বছরে! ২০১২ সালের আগস্ট মাসে যখন দেশ ছাড়লাম, তখন থেকে কম তো দেখলাম না। সব কাহিনী সবার সামনে বলাও হয়ে ওঠেনি। সারাংশ হচ্ছে, এখন ভালো আছি। আবার কখন পরিস্থিতি পাল্টে যায়, কে জানে!
প্রবাস জীবনে ভালোর মধ্যে দুটো মাস্টার্স, একটা পিএইচডি, আর্গন ন্যাশনাল ল্যাবে চাকরি, বাড়ি-গাড়ি, আর বলতে গেলে প্রায় পুরো যুক্তরাষ্ট্র ঘুরে ফেলা, ইত্যাদি। কিন্তু ভালোগুলোর কথা সবাই জানে; ভালোগুলোর কথাই সবাই বলে। আজকে খারাপগুলো নিয়ে বলি। খারাপ তো অনেক, তার মধ্যে তিনটা ঘটনা সবচেয়ে স্মরণীয় আমার জন্য, যার মধ্যে একটা আমার খুব কাছের বন্ধুরা ছাড়া কেউ জানে না –
(১) আরকানসা’র বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট অফিসার সময়মত আমার সেভিস আপডেট করেনি, তাই আমার কোনো দোষ না থাকা সত্ত্বেও আমি আমেরিকাতে টেকনিক্যালি ইলিগ্যাল হয়ে গেছিলাম, ডিপার্টমেন্ট অফ হোমল্যান্ড সিকিউরিটির সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছিলাম। ঘটনা অনেক লম্বা, কিন্তু সারাংশ হচ্ছে – দশদিন লেগেছিলো এই সমস্যার মিটমাট করতে। অনেক ল…ম্বা ছিলো ঐ দশদিনের প্রত্যেকটা দিন।
(২) পিএইচডির একটা ব্যর্থ প্রচেষ্টা, সেখানে দু বছর নষ্ট হওয়া। লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে একাডেমিক্যালি এত বাজে সময় কেটেছে যে, কী বলবো। মাস্টার্স নিয়ে বের হতে পারতাম, সেটারও ইচ্ছে হয়নি। মাস্টার্স করলে OPT তে গিয়ে চাকরি করতে পারতাম, কিন্তু এগুলোর চেয়ে দেশে ফিরে যাওয়াটাই অপেক্ষাকৃত ভালো প্ল্যান মনে হয়েছিলো। তাই, ২০১৬ সালের জুন মাসে দেশে চলে গেলাম। সত্যি বলতে, দেশে সময়টা খুব একটা খারাপ কাটেনি। কিন্তু ক্যারিয়ারের দিক থেকে পিছিয়ে গিয়েছিলাম।
(৩) দেশে ফিরে যাওয়ার তিন মাসের মধ্যেই (সেপ্টেম্বর/অক্টোবরের দিকে) আরেকটা পিএইচডি এসিস্ট্যান্টশিপ যোগাড় করলাম, জানুয়ারি (স্প্রিং সেশন) থেকে শুরু করবো আবার। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে এম্ব্যাসি ইন্টারভিউ দিলাম। ওরা বললো, “তোমার ভিসা এপ্রুভ করলাম, কিন্তু হোমল্যান্ড সিকিউরিটির কাছ থেকে আরেকটা রেকর্ড লাগবে (এক নম্বরে উল্লেখ করা ঝামেলার কারণে)। তোমাকে কিছু করতে হবে না, ওটা আমরাই নিয়ে নেবো। দশদিনের মধ্যে ভিসা পেয়ে যাবে।”
সেই ভিসা এলো না এক মাস পরেও। জানুয়ারিতেও এলো না, স্প্রিং সেশন মিস করলাম। ফেব্রুয়ারিতেও যখন এলো না, তখন ভাবলাম – অনেক সময় নষ্ট হচ্ছে। তখন, নর্থ সাউথে একটা চাকরি নিলাম। মার্চ মাসে, পুরোপুরি হতাশ হয়ে, বেশ কঠোর ভাষায় একটা ইমেইল লিখলাম এম্ব্যাসিকে। এতে কাজ হলো – ওরা বললো, আরো একটা ডকুমেন্ট লাগবে। মূলত, পুরো ঘটনায় আমার কোনো দোষ ছিলো না, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি আমাকে কোর্টে হাজির না করেই ছেড়ে দিয়েছে – এরকম একটা ডকুমেন্ট। সমস্যা হচ্ছে – দলিলটা লুইজিয়ানার একটা অফিসে গিয়ে আনতে হবে। আরে, নিজে গিয়ে আনবো কীভাবে? সেজন্যেও তো ভিসা দরকার। বন্ধুভাগ্য ভালো বলে এ যাত্রা বেঁচে গেলাম। লুইজিয়ানাতে বন্ধু ছিলো, সে গিয়ে আমার প্রতিনিধি হয়ে দলিলটা নিয়ে এলো, আমাকে স্ক্যান করে একটা কপি পাঠিয়ে দিলো। এপ্রিলে ভিসা পেলাম, মে এর শেষের দিকে (অর্থাৎ, ছয় মাসের জায়গায় এক বছর পর) যুক্তরাষ্ট্রে সেকেন্ড ইনিংস শুরু করলাম।
_________
এরপরেও মাঝে মাঝে এদিকে ওদিকে খারাপ সময় গেছে, কিন্তু সেগুলো এগুলোর মত এত ভয়াবহ না। বিশেষ করে, জর্জিয়াতে আসার পরে ক্যারিয়ারের বিলম্ব অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। প্রথম ইনিংস এর চার বছরে (মানে, ২০১২ এর অগাস্ট থেকে ২০১৬ এর জুন পর্যন্ত) ব্যাগে ছিলো শুধু একটা মাস্টার্স। দ্বিতীয় ইনিংসের সাড়ে তিন বছরে (মানে, ২০১৭ এর জুন থেকে ২০২০ এর ডিসেম্বরের মধ্যে) ব্যাগে ঢুকলো সেই বহুল আকাঙ্ক্ষিত ডক্টর উপাধি, সাথে বোনাস হিসেবে আরেকটা মাস্টার্স।
মাঝে মাঝে চিন্তা করি, বিকল্প ভবিষ্যত কেমন হতে পারতো। পরিবেশ বিজ্ঞানী না হয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো প্রবল। কাকতালীয়ভাবে দুইবার – একবার পরিস্থিতির পাল্লায় পড়ে, আরেকবার নিজের ইচ্ছায় – কৃষি অর্থনীতিবিদের ক্যারিয়ার করা হলো না।
(১) অনিচ্ছায় – লুইজিয়ানাতে প্রথম প্রচেষ্টাতে পিএইচডি হয়ে গেলে তো এখন কৃষি অর্থনীতিবিদই হতাম। এমনকি ওখান থেকে মাস্টার্স নিয়ে কোনো চাকরিতে ঢুকলেও সেটাই হতো আমার ক্যারিয়ার। আর…
(২) ইচ্ছায় – ২০২৩ এর শুরুর দিকে, ইচ্ছাকৃতভাবে কৃষি অর্থনীতিবিদ হিসেবে সম্ভাব্য ক্যারিয়ারটা ছেড়ে দিলাম। টেনিউর ট্র্যাক এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর পজিশনের অফার পেয়েছিলাম, ইউনিভার্সিটি অফ টেনেসি নক্সভিলের এগ্রিকালচারাল ইকোনোমিকস ডিপার্টমেন্টে। পাশাপাশি, একই সপ্তাহে, আর্গন ন্যাশনাল ল্যাব থেকে স্টাফ সায়েন্টিস্ট হিসেবে স্থায়ী চাকরির অফার পেলাম। জীবনে খারাপ সময় অনেক গেছে, কিন্তু তখন কী করবো সেটা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগিনি কখনোই। লেগে থাকতে হবে, পরিশ্রম করতে হবে – এগুলোই ছিলো উত্তর। কিন্তু এই পরিস্থিতিটা ভিন্ন। এর সবচাইতে কঠিন সিদ্ধান্ত মনে হয় আর কখনোই নিতে হয়নি। শেষমেষ, পরিবেশ বিজ্ঞানী হয়ে আর্গনেই থেকে গেলাম। সিদ্ধান্তটা ভালো হলো নাকি খারাপ হলো, সেটা ভবিষ্যত বলে দেবে।
অনেকে অধ্যবসায় বলেন, অনেকে নিষ্ঠা বলেন। আমি বলি, আমি আসলে একটু ঘাড়ত্যাড়া। একবারে না পারলেও ঘাড়টা আগের জায়গায় আসে না, অন্তত দ্বিতীয়বার চেষ্টা করিই। আর কিভাবে কিভাবে যেন দ্বিতীয় চেষ্টাটা প্রথমটার চেয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো জায়গায় হয়। অনার্সের পর আমার কোনো কিছুই একবারে হয়নি – না মাস্টার্স, না পিএইচডি। বাংলাদেশে থাকতে একটা মাস্টার্স করতে চেয়েছিলাম, সুপারভাইজার আমার থিসিস পছন্দ করলেন না। পরের বছর থিসিস জমা না দিয়ে চলে আসলাম আমেরিকায় মাস্টার্স করতে। পিএইচডি শুরু করেছিলাম লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে, টিকতে না পেরে পরের বার ট্রাই করলাম ইউনিভার্সিটি অফ জর্জিয়াতে। আর্গনেও ঢুকেছি দুইবার ইন্টারভিউ দিয়ে। ইউনিভার্সিটি অফ টেনেসিতেও ফ্যাকাল্টি পজিশনের অফার পেয়েছি দ্বিতীয়বারে – দুইবার দুই ডিপার্টমেন্টে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম, দ্বিতীয় পজিশনটা প্রথমটার চেয়ে বেটার ছিলো।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে একটু ঘাড়ত্যাড়া হওয়া খারাপ না। বিদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে তো এটা একটা প্লাস পয়েন্ট। খারাপ সময় কাটিয়ে ওঠার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই।