২০১২ সালে আমি পড়াশোনা করার জন্য আমেরিকাতে আসি। বাংলাদেশ থেকে ১০ হাজার মাইলেরও অধিক ভ্রমণ করে আমেরিকা আসার পর যা দেখলাম, তাতে মুভিতে দেখা আমেরিকার কোনো মিল নাই। এসে পড়লাম আরকানসা’ (Arkansas) নামক দরিদ্র একটা অঙ্গরাজ্যের ছোটো একটা শহরে, এখানে উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু আছে বলে কখনো শুনি নাই।

মানুষের সাথে আলোচনা করে যা বুঝলাম, আরকানসা’বাসীদেরও গর্ব করার মত কিছু কিছু জিনিস আছে। আমেরিকার, এমনকি হয়তো বিশ্বের, সবচেয়ে বড় চেইন সুপারস্টোর ওয়ালমার্টের মালিক আরকানসা’র অধিবাসী। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন আরকানসা’র গভর্নর ছিলেন। তবে সবচেয়ে বেশি যে অর্জনটা আমাকে নাড়া দিয়ে গেলো, তা ছিলো – এই স্টেটেই প্রথমবারের মত শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গরা একই স্কুলে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলো।
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত অনেক স্টেটে আইনই ছিলো এমন যে ওখানে শ্বেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গরা এক স্কুলে পড়তে পারবে না। কৃষ্ণাঙ্গ অলিভার লিওন ব্রাউন ক্যানসাসের টোপেকা শহরে থাকতেন। ঐ শহরের স্কুল তার মেয়েকে ভর্তি করতে রাজি হচ্ছিলো না। তাই তিনি ১৯৫১ সালে টোপেকার বোর্ড অফ এডুকেশনের বিরুদ্ধে মামলা করে দেন। সেই মামলা গড়াতে গড়াতে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গিয়েছিলো। এর মধ্যে কেটে গেলো তিন বছর। ১৯৫৪ সালে, সুপ্রিম কোর্ট সকল স্টেটের জন্য আইন পাশ করে যে এ ধরনের পৃথকীকরণ করা যাবে না। অলিভার ব্রাউন মামলা জিতে গেলেন। সেই বিখ্যাত মামলাটার নাম Brown Vs Board of Education.
আইন বদলে যাওয়ার পর কিছু কিছু স্কুল শ্বেতাঙ্গদের স্কুলে আফ্রিকান আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গদেরকে ভর্তি করানোর চেষ্টা করে। ১৯৫৭ সালে, আরকানসা’র রাজধানী লিটল রক শহরের Little Rock Central High School এ নয়জন কৃষ্ণাঙ্গ ভর্তি হয়েছিলো।
বাংলাদেশে স্কুলের ক্লাস শুরু হয় জানুয়ারিতে, আমেরিকাতে শুরু হয় সেপ্টেম্বরে। ক্লাস শুরু হওয়ার সাথে সাথেই বাক-বিতণ্ডা শুরু হয়ে গেলো। ২৩শে সেপ্টেম্বরে এসে, এই ৯ জনের ওপর নেমে এলো ভয়ের বিষণ্ণ ছায়া। তাদের সামনে এসে হাজির হলো হাজারের ওপরে উগ্র শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানের একটি দল। এরা সবাই বিদ্রোহ করছিলো স্কুলের সামনে। এরা চায়নি যে, কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্ররা সেই স্কুলে পড়ার সুযোগ পাক। লিটল রক এর পুলিশ ঐ ৯ জনকে নিরাপদে স্কুলের ভেতরে সরিয়ে নিয়েছিলো। ওরা স্কুল থেকে বের হতে পারলো না, সেদিন ঘরে ফিরে যেতে পারলো না।

পরেরদিন পরিস্থিতি নিজের হাতে তুলে নিলেন খোদ প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার। তিনি ১২০০ সৈন্য পাঠালেন যাতে ঐ ৯ জনকে নিরাপদে স্কুলে পৌঁছে দেয়া যায়। আর সেটাই আপনারা এই ছবিটাতে দেখতে পাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, যে কোনো মুহূর্তে যদি অবস্থা আরো ঘোলাটে হয়ে যায়, সেজন্য আরকানসা’র ১০,০০০ সৈন্যকে জাতীয় (ফেডারেল) ক্ষমতার এখতিয়ারে নিয়ে আসেন। তখন ঐ ৯ জনকে ৩ দিন স্কুলের মধ্যে আটকে থাকতে হয়েছিলো। অনেক পরে সেই ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ৯ জনের ১ জন বলেছিলেন, “তখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম, একত্রীকরণ (integration) শব্দটা আসলে আমি যা ভেবেছিলাম, তার চেয়ে অনেক বড়।”
পুরো আমেরিকা তখন এই খবরটা দেখলো, তোলপাড় হয়ে গেলো। এই প্রথম ওরা বুঝতে পারলো যে, ১৯৫৪ সালে একত্রীকরণের যে আইনটা করা হয়েছিলো, তা আসলে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। এরপর থেকে সবাই আস্তে আস্তে বুঝতে পারে যে, জাতীয় সরকার এই আইন বাস্তবায়নে কতটা সচেতন! যদিও আইন সাথে সাথে বাস্তবায়ন হয়নি। সেই বছরটা ওরা ক্লাস করতে পেরেছিলো। কিন্তু পরের বছর শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ সকল ছাত্রের জন্যেই স্কুল বন্ধ ছিলো। কারণ, আরকানসা’র তৎকালীন গভর্নর নিজের পার্টির সদস্যদের চাপে পড়ে একত্রীকরণ পিছিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তিনি মামলা করেছিলেন একত্রীকরণের বিরুদ্ধে। মামলায় হেরে গিয়ে, মারামারির দোহাই দিয়ে, তিন বছরের জন্য একত্রীকরণ পিছিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, এক বছর পরেই, আবার স্কুল খুলে যায়। ঐ এক বছর সব ছাত্ররা টিভিতে ক্লাস করেছিলো। প্রথম “রিমোট” ক্লাসের উদাহরণ হয়তো এটাই।

সেই নয়জনকে একসাথে করে বলা হয়, Little Rock Nine. তারা ইতিহাসের অংশ! সরকার এই ৯ জনকে রক্ষা করার মাধ্যমে এটাই বুঝিয়েছিলো যে, যে কোনো উগ্র গোষ্ঠীর উন্মত্ত চিন্তাকে সরকার চাইলেই কঠোর হস্তে দমন করতে পারে। আমাদের বাংলাদেশের সরকার এই জিনিসটা বোঝে না ভোটের স্বার্থে। কিন্তু তারা যে উগ্রতার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে তাদেরকে মৌন সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে, এমনকি উগ্রতার বিরুদ্ধে কলম ধরা মানুষদেরকে হাজতে ঢোকাচ্ছে – এগুলোতে আর যাই হোক, ইতিহাসের পাতায় তাদেরকে মোটেও সম্মানের সাথে লিপিবদ্ধ করা হবে না।
