ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে – You talk the talk, do you walk the walk? অর্থটা হচ্ছে, মুখে তো অনেক কথার তুড়ি ছোটাও, কাজের বেলায় কতটুকু? সোজা বাংলায় কাছাকাছি প্রবাদটা হচ্ছে, “বলা সহজ, করা কঠিন”। কিন্তু সেদিন একটা সিনেমা দেখলাম, আক্ষরিক অর্থে হাঁটা নিয়ে – The Walk, এমন একজনের কাহিনী যে শুধু মুখে বলেনি, সত্যি সত্যি হেঁটেছেও। কিন্তু এমন কোথায় হেঁটেছে যে তাকে নিয়ে গোটা একটা মুভি হয়ে গেলো?

ইতিহাস নিয়ে সচেতন প্রত্যেক পাবলিকই জানে, ঘটনাটা সত্যিই ঘটেছিলো। ১৯৭৪ সালের ০৭ই আগস্ট, ফেলিপ পেতিত নামে এক ফরাসী পাগল(!) আমেরিকার ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের এক টাওয়ার থেকে আরেক টাওয়ারে হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। পাগল বললাম, কারণ এটা ছাড়া আর কিছু মাথায় আসছে না। ৪০০ মিটার উঁচু ১১০ তলা দুটো বিল্ডিং, একটা থেকে আরেকটার দূরত্ব ১৪০ ফুট। একটা চিকন দড়ির ওপর হেঁটে এপার থেকে ওপারে যাওয়ার কথা যে ভাবতে পারে, তাকে পাগল ছাড়া আর কী বলা যায়?
মুভিটা রিলিজ পেয়েছিলো ২০১৫ সালে। আমার মনে আছে, ট্রেইলার দেখার পর থেকেই মুভিটা দেখার অপেক্ষায় ছিলাম। এর আগে এই কাহিনীটার কিছুই আমি জানতাম না। ট্রেইলার দেখার পর অনেক কষ্টে গুগল করে সবকিছু জেনে ফেলার লোভ সংবরণ করেছি। আমি জানতে চাইনি, আসলে সে পেরেছে, নাকি পড়ে মরেটরে গেছে! মনের মধ্যে কত শত শত চিন্তাভাবনা! এই ব্যাটাকে নিয়ে যেহেতু সিনেমা হচ্ছে, তাহলে ব্যাটা নিশ্চয়ই সফল হয়েছিলো। আবার পড়ে গিয়ে মরে গেলেও বিশাল খবর, সেটা নিয়েও সিনেমা হতে পারে। ঘটনাটা নিয়ে আমার ইগনোরেন্সটাকে আরো কয়েকদিন লালন-পালন করলাম। এখানে উল্লেখ্য, ইগনোরেন্স কিন্তু bliss নহে।
মনে আছে, যেদিন রিলিজ পেয়েছিলো, সেদিনই থিয়েটারে ছুটে গিয়েছিলাম। দুরুদুরু বুক নিয়ে পুরো সিনেমাটা দেখেছিলাম। সকল বাধা পেরিয়ে ফিলিপ যখন দড়ির ওপর দাঁড়ালো, তখন থেকে টের পাচ্ছিলাম, আমার শ্বাস-প্রশ্বাসের হার বেড়ে যাচ্ছে। আমি বুকে হাত দিয়ে দেখলাম, আমার হৃৎপিণ্ড দৌড়াচ্ছে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক দ্রুত গতিতে। এরপর দৃশ্যের মধ্যে হারিয়ে গেলাম। শুরু হলো, The Walk On The Wire. হঠাৎ এক সময় লক্ষ্য করলাম, আমি তো নিঃশ্বাসই নিচ্ছি না। ঠিক এই অনুভূতিটার জন্যেই তো মুভি দেখতে চাই। পরিচালক রবার্ট জেমেকিস, অভিনেতা জোসেফ গর্ডন লেভিট, গ্রাফিক্স প্যানেল, সম্পাদক – সবার উদ্দেশ্যে “হ্যাটস অফ”।

জোসেফ গর্ডন লেভিটকে তো এমনিতেই ভালো লাগে। এই সিনেমাতেও সে ফ্রেঞ্চ “পাগল” এর ভূমিকাতে চরম অভিনয় করেছে। আর অ্যানির চরিত্রে ফ্রেঞ্চ কানাডিয়ান অভিনেত্রী শার্লটকে যে কী মিষ্টি লাগলো, বলে বোঝানো যাবে না।

গল্প তো বাস্তব, ভালো কথা! স্ক্রীনপ্লেও খুব ভালো করেছে। একটা দৃশ্যে ফিলিপ, তার ভয়াবহ উচ্চতা-ভীতু বন্ধুকে নিয়ে, সব সেটাপ করছিলো টুইন টাওয়ারের ছাদে। এমন সময় সেখানে একজন উঠে আসে, একদম হঠাৎ। সেই সিনটা দেখে The Good, The Bad, and The Ugly সিনেমার ক্লাইম্যাক্সের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো, যেখানে তিনজনই নিজের বন্দুক নিয়ে প্রস্তুত; কে কাকে গুলি করবে, কখন গোলাগুলি শুরু হবে, সেটার জন্য দর্শক নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে থাকে, ঠিক সেরকম।
একটা জায়গায় আমার সমালোচনা আছে। এখানে ফিলিপের চরিত্রটা প্রথম থেকেই ন্যারেশন করছিলো। এই স্টাইলটা আমার পছন্দ হয়নি। দর্শককে ফিলিপের কথাগুলো এভাবে সরাসরি না শুনিয়ে কাহিনীর মধ্য দিয়েই বোঝানো যেতো। তাহলে স্ক্রীনপ্লে আরো শক্তিশালী হতো। সোজা কথায়, “show, don’t tell”. আর শেষের দিকে সম্পাদনার কাটছাঁট আরো ভালো হতে পারতো। তারপরেও ভিজ্যুয়াল ইফেক্টের জন্য বেশ অনেকগুলো নমিনেশন আর পুরষ্কার পেয়ে গেছে The Walk.
থিয়েটার থেকে বাসায় এসে এবার গুগলিং শুরু করেছিলাম। সে দড়িতে উঠেছিলো, এটুকুই বলবো আমি। কী হয়েছিলো, তা আর বলবো না। তবে সিনেমাতে দেখেছিলাম, দড়িতে ওঠার পর ফিলিপের ছবি তোলা হয়েছিলো। সেই ছবি নিশ্চয়ই আছে ইন্টারনেটে ভেবে সার্চ দিলাম। এই সেই ছবি…

সিনেমার মধ্যে জোরালো মিউজিক ছিলো, সাউন্ড ছিলো। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে যেন নিজের বুকের ধুপধাপ আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। কিছু কিছু দৃশ্যে সাউন্ড বন্ধ করে তাকিয়ে থাকতে পারেন। হয়তো সত্যি সত্যিই নিজ কানে শুনতে পাবেন।
প্রথম প্রকাশঃ অক্টোবর ০১, ২০১৫ (ফেসবুক নোট)
ঈষৎ পরিবর্তিত দ্বিতীয় প্রকাশঃ অক্টোবর ০১, ২০২৫ (এখানে)