হিজড়া চাঁদাবাজি – সমস্যা ও সমাধান

এমন একটা বিষয় নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই যেটা নিয়ে আসলে খুব একটা কথা বলা হয় না। নিঃসন্দেহে বিষয়টা নিয়ে আগের চেয়ে কিছুটা হলেও বেশি কথা হচ্ছে, তবুও কোনোভাবেই যথেষ্ট নয়। কথা বলতে চাই তৃতীয় লিঙ্গ, তাদের সমস্যাগুলো, এবং তাদের দ্বারা তৈরি সমস্যাগুলো নিয়ে।

হিজড়ারা কেন সমস্যা?

কারণ একটাই – আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতার জন্যেই তারা অবহেলিত, নিগৃহীত। আমাদের সমাজের অধিকাংশের চাপে পড়ে এরা বেকার থেকে যায়; এদেরকে কেউ পড়াশোনা করতে দেয় না, প্রশিক্ষণ বা চাকরিও দেয় না; ব্যবসা করতে গেলেও থামিয়ে দেয়। আমি অনেক হিজড়াদের সাথে কথা বলেছি, সবার একই গল্প। কাউকে তাদের পিতামাতা ঘর থেকে বের করে দিয়েছে, কিভাবে ওরা বেঁচে থাকবে জানতেও চায়নি। এক হিজড়া বলেছিলো যে সে অনেক কষ্টে কিছু টাকা যোগাড় করে একটা চা-সিগারেটের ছোট্ট দোকান দিয়েছিলো। পুলিশ নিজেই এসে সেই দোকান ভেঙে দিয়েছিলো। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এলাকার লোকজনই পুলিশের কাছে গিয়ে এই অভিযোগ করে এসেছিলো, দোকান বন্ধ করতে বলেছিলো। অর্থাৎ, আমরা ওদেরকে সমস্যা মনে করি দেখেই ওরা সমস্যার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিলো।

এখন সমাজের মানুষগুলোর চাপে পাওয়া বেকারত্বের বোঝা তারা বহন করে সমাজের ঐ মানুষগুলোর কাছ থেকেই চাঁদাবাজি করে। পরিহাস আর কাকে বলে! এই পর্যায়ে এসে তারা আসলেই নিজেদেরকে সমস্যায় পরিণত করেছে। এসব নিয়ে কিছু কথা শুরু থেকে শুরু করতে চাই। কারণ আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই বিষয়টাকে অনেকেই অস্বস্তিকর মনে করে, এবং পারতপক্ষে এড়িয়ে যেতে চায়। কেন এড়িয়ে যেতে চায়, সেটাও একটা ব্যাপক আলোচনার বিষয়।

কেন হিজড়াদেরকে নিয়ে কেউ কথা বলতে চায় না?

আমাদেরকে ছোটোবেলা থেকেই সাদা-কালো মানসিকতা নিয়ে বড় হবার শিক্ষা দেয়া হয়। হয় কোনো জিনিস ভালো, নয়তো খারাপ। হয়তো কেউ সমকামী, নয়তো বিষমকামী। হয়তো কেউ পুরুষ, নয়তো মহিলা। শিশুদেরকে যদি ছোটোবেলা থেকেই এটা বলা হয় যে নারী-পুরুষ ছাড়া উভলিঙ্গরাও বিদ্যমান, তাহলে ওরা যতটা না আশ্চর্য হবে, তার চেয়ে বেশি বিব্রত হয়ে পড়েন প্রাপ্তবয়স্করা। এই অস্বস্তির পেছনে কারণগুলো খুবই সংবেদনশীল। বাংলাদেশে বেশির ভাগই ধার্মিক এবং তারা মনে করে যে মানুষ ঈশ্বরের সৃষ্টি। এখন ঈশ্বর যেখানে বলে দিয়েছেন যে তিনি পুরুষ ও নারীকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন, তখন সেখানে তৃতীয় লিঙ্গের সামনে পড়লে একটু থতমত খেতেই হয়। এই কারণে হিজড়াদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে তৃতীয় একটি লিঙ্গের মর্যাদা দেয়ার কথা চিন্তা করতেও লেগে গেছে বহুদিন।

ব্যতিক্রম নিয়ে চিন্তা করতে না চাওয়া আমাদের প্রজাতির একটা চরম সমস্যা। যেহেতু একটা শ্রেণীবিভাগের আওতায় ৯৯ শতাংশের মত (বা অধিক) জনসংখ্যা এসে গেছে, তাই বাকিদের কথা না ভাবলেও বাঙালির চলে। সংখ্যালঘুদের প্রতি বাংলাদেশিদের আচরণ যে কতটা নিষ্ঠুর, এটা তো সাম্প্রতিক ইতিহাস আমাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। সামাজিকভাবে কোনো প্রথা দাঁড় করানোর আগে আমরা সংখ্যালঘুদের কথা চিন্তাও করি না। আর এই সংখ্যালঘুরা (হিজড়ারা) যেহেতু দেখতে আমাদের মত তথাকথিত “স্বাভাবিক” নয়, তাই ব্যাপারটা আর শুধু অবজ্ঞায় থাকেনি, নেতিবাচকতায় পরিণত হয়েছে।

হিজড়াদের চাঁদাবাজি

অনেক হিজড়াই এখন ধর্ম আর কুসংস্কারে বিশ্বাসী মানুষদেরকে কাছ থেকে চাঁদা আদায় করার জন্য জীবন ধ্বংস হয়ে যাওয়ার অভিশাপ দেয়। অভিশাপের ভয়ে মানুষ চাঁদা দিয়েও দেয়। এমনকি দোকানগুলোতে নাকি ওপর মহল থেকেই বলে দেয়া হয়েছে যাতে ওরা আসলে দশ টাকা করে দেয়া হয়। এরপর হিজড়ারা বাস চালকদের মত পরিবহন শ্রমিকদের কাছ থেকেও টাকা আদায় (পড়ুন, চাঁদাবাজি) শুরু করলো। পুলিশ দেখে, কিচ্ছু বলে না। এখন হিজড়াদের পাশাপাশি বেদে’র দল নতুন করে চাঁদাবাজি শুরু করেছে। গোদের ওপর বিষফোঁড়া! সবকিছুর একটা সীমা আছে। তাই, আজ চট্টগ্রামে পরিবহন ধর্মঘট হয়ে গেলো। তিনটা সত্যিকারের ঘটনা বলতে চাই হিজড়াদের দ্বারা তৈরি সমস্যাগুলো নিয়ে।

ঘটনা ১ – ঢাকার পান্থপথ বাস কাউন্টারে বসে চট্টগ্রামে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ওয়েইটিং রুম থেকে বেরিয়ে বাসে উঠতে যাবো, এমন সময় টি শার্ট আর টাইট জিন্স পরা একটা হিজড়া এসে পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে গেলো। এসেই বললো, “অ্যাই, টাকা দে।” কোনো অনুরোধ নয়, আদেশ! আমি তখন বললাম, “আপনি কি আমার কাছ থেকে টাকা পান? আর তুই তুই করে বলছেন কেন? আপনি কি আমার পরিচিত?” তখন সে ক্ষিপ্ত হয়ে বললো, “টাকা না দিলে অভিশাপ দিবো, তোর জীবন ধ্বংস হয়ে যাবে।” আমি উত্তর দিলাম, “অভিশাপ জিনিসটাকে আমি ভয় পাই না। অভিশাপ কাজে আসে না। দেখি, এমন কোনো অভিশাপ দেন তো, যাতে দুই মিনিটের মধ্যে আমি মরে যাই?” সে তখন চিৎকার করে উঠলো, “শয়তান”। এরপর ইংরেজিতে চিৎকার করলো, “Don’t show me your dirty face.” আমি তার চেয়ে উঁচু গলায় জবাব দিলাম, “YOU HAVE ALREADY SHOWN YOURS.” সাথে স্ত্রী আর শ্বাশুড়ি ছিলো (তখনো বিয়ের কয়েকদিন বাকি আমাদের, ঢাকায় একসাথে গিয়েছিলাম শপিং করতে), ওরা দুজনেই প্রচণ্ড ভয়ে ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিলো। কেউই চাচ্ছিলো না, আমি আর কথা বাড়াই। তাই, হিজড়া আরেকটু দূরে গিয়ে চিৎকার করতে থাকলেও আমরা বাসে উঠে গিয়েছিলাম।

ঘটনা ২ – আমার বিয়ের সময় যখন স্ত্রীর বাবা বাড়ি সাজিয়েছিলো, তখন হিজড়ারা খবর পেয়ে টাকার জন্য বিল্ডিং এর সামনে শুয়ে পড়লো। পুলিশকে ফোন করার পর ওরা বললো, “টাকা দিয়ে দিন। কারণ, আজ না হয় আমরা এসে তাড়াবো, কালকে কী করবেন?” —– তাদের প্রতি আমার সহানুভূতি আছে, কিন্তু এ তো স্পষ্ট অত্যাচার! তাদের দরাদরির স্টাইল স্বাভাবিকের চেয়ে একদম উল্টো। সাধারণত কেউ হয়তো প্রথমে বেশি চাইবে, পরে আস্তে আস্তে সেটার চেয়ে কম কোনো পরিমাণে রাজি হবে। কিন্তু ওরা প্রথমে এসে ৫ হাজার টাকা চেয়েছিলো। দিতে রাজি না হওয়ায় তারা ১০ হাজার দাবি করে বসলো। পুলিশের সাহায্য পাওয়া যাবে না বুঝে নিয়ে শ্বশুরমশাই কোনোমতে ৫ হাজার দিয়েই বিদায় করলেন। তবে এর চেয়েও খারাপ ঘটনা আছে।

ঘটনা ৩ – চট্টগ্রামের এক রড ব্যবসায়ীর দোকানে এসে একজন হিজড়া চাঁদা চেয়েছিলো। দোকানের মালিক তাকে চলে যেতে বললো, স্বাভাবিকভাবে অস্বীকৃতি জানালো। কিন্তু হিজড়া চাঁদা না নিয়ে যাবেই না। দুজনের মধ্যে বাকবিতণ্ডাও হয়েছিলো। দোকানদার এবার তাকে কড়া ভাষায় চলে যাওয়ার আদেশ দিলো। হিজড়াও মুখ খারাপ করা শুরু করলো। দোকান যেহেতু রডের, সেখানে অনেক রড ছিলো, আর কর্মীও ছিলো। হিজড়াটা না গেলে তাকে পেটাবে বলে হুমকি দিলো দোকানদার। তখন সেই হিজড়া চলে গেলো। এবং সেদিন সন্ধ্যার সময় এক মাইক্রোতে করে কয়েকজন হিজড়া এসে দোকানদারকে অপহরণ করে নিয়ে গেলো। পরে ওনার আত্মীয়স্বজনরা গিয়ে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দিয়ে তাকে মুক্ত করে নিয়ে এসেছিলো।

অপহরণ এবং চাঁদাবাজি – দুটোই দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু আজ দুইজন আইনজীবির সাথে কথা বলে জানলাম, বাংলাদেশ সরকারের কাছে হিজড়াদেরকে এসব অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করার কোনো উপায় নেই। তারা এসব ব্যাপারে ইমিউনিটি ভোগ করে। ওরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে পুরুষ-মহিলা সবার গায়ে হাত দিচ্ছে, অনেকের যৌনাঙ্গেও হাত দিচ্ছে, চাপ দিচ্ছে; কিন্তু এদেরকে কিচ্ছু বলার উপায় নেই। পাশেই পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকে, দেখে মুচকি মুচকি হাসে। আরো শুনলাম, ওদের নাকি বিশাল সংগঠন আছে, একজন নাকি রাণীও আছে- সারা বাংলাদেশের হিজড়া রাণী!

সমাধান

সমস্যা যেহেতু দৃষ্টিভঙ্গি, সেটাকে পাল্টানোই হচ্ছে সমাধান। রাতারাতি পট পরিবর্তন হবার বা এই সমস্যা সমাধানের কোনো সুযোগ নেই। তবে কাজ শুরু করতে হবে তিনটি প্রকল্প হাতে নিয়ে (সরকার বা এনজিও যেই করুক না কেন)…

১) বর্তমানে প্রাপ্তবয়স্ক হিজড়াদেরকে দ্রুত পুনর্বাসন (কারিগরী প্রশিক্ষণ) ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।

২) অপ্রাপ্তবয়স্ক হিজড়াদেরকে অন্যান্য শিশুদের মত একাডেমিক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

৩) সমাজের অন্য সকলের মধ্যে হিজড়াদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরির জন্য প্রচারণা চালাতে হবে।

যতবারই কোনো হিজড়া আমার কাছ থেকে চাঁদা চাইতে এসেছে, আমি সবাইকেই পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করার পরামর্শ দিয়েছি, তাদের গল্প শুনেছি, এবং শক্ত সমর্থ হবার পরেও ভিক্ষা না করে নিজের আত্মসম্মান ধরে রাখার অনুরোধ করেছি। অবশ্যই মনে রাখতে হবে, এখানে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনটাই বেশি জরুরি। আমরা যদি ওদেরকে মানুষ মনে না করি, যদি সমান মর্যাদা না দেই, তাহলে আইনের চোখে ওদেরকে সমানভাবে অপরাধের জন্য দায়ী ঠাওরানো যাবে না। “আইন সবার জন্যেই সমান”- এটার চর্চা করতে হলে তাদেরকে সবার মত এক কাতারে নিয়ে আসতে হবে; অধিকার এবং দায়িত্ব, দুই ক্ষেত্রেই।

Share:

1 comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *